User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
প্রকৃতপক্ষে সংগীত এমন এক প্রকার শিল্পমাধ্যম, যার রস আস্বাদনে ব্যক্তিকে নির্বাসিতের দায়ভার গ্রহণ করতে হয় না। অন্যান্য শিল্পকলা যেমন চিত্র, কাব্য, নাট্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে রসগ্রহীতাকে তার মনোযোগের সবটা ওই বিশেষ মাধ্যমেই নিবদ্ধ করতে হয়; সম্পূর্ণ একাগ্রতা বজায় রাখতে হয় কিন্তু সংগীতের ক্ষেত্রে এমনটি না করলেও চলে। সংগীত শ্রবণের ফাঁকে ফাঁকে একাধিক কাজ করার অবসর ব্যক্তির থাকে। ফলে আজকের এই ছোটাছুটি ও কর্মব্যস্ততার দুনিয়ায় মানুষের বিশ্রাম ও বিনোদনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সঙ্গীটি হলো এই সংগীত। আবার কাজের ভেতরেও সংগীতই অনুপ্রেরণা ও পৃথক শক্তি জোগায়। কখনো নেপথ্যে, কখনো সরাসরি সংগীত হয়ে ওঠে কাজের পরিপূরক, যেমন ওয়ার্ক সং বা কর্মসংগীত গাইতে গাইতে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ তাঁদের পেশাগত কর্মের কায়িক শ্রমটি সম্পাদন করে থাকেন। তাই কাজে ও বিশ্রামে, নিদ্রা ও অনিদ্রায় সংগীতই আধুনিক মানুষের পরম আশ্রয়ের স্থল। সংগীতের প্রথম কালে এটি ছিল ধর্মীয় অনুষঙ্গ। কিন্তু সময়ের প্রবহমানতায় সংগীতই স্বয়ং ধর্ম হয়ে ওঠে; অনুষঙ্গ থেকে রূপান্তরিত হয় মূল প্রসঙ্গে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংগীতের মধ্যে প্রধানতম পার্থক্যের জায়গাটি হলো, পাশ্চাত্যের সংগীত পূর্বনির্ধারিত বা নির্দিষ্ট। এখানে একটি কম্পোজিশন আগে থেকেই তৈরি করা থাকে, পরবর্তী সময় গায়ক শুধু সেটা পরিবেশন করেন। আর প্রাচ্যে এটি অনির্ধারিত এবং অনির্দিষ্ট, গায়ক তাঁর পরিবেশনের সময়েই এটিকে তৎক্ষণাৎ তৈরি করেন। গায়কের ইচ্ছানুযায়ী উপস্থিত মঞ্চেই কম্পোজিশনটির জন্ম হয়, যা পূর্বনির্ধারিত নয়। গায়কের সৃজনশীলতার ওপর এটি পুরোপুরি নির্ভরশীল। ন্যূনতম কী কী গুণ থাকলে একজন শ্রোতাকে সমঝদার বা সংগীত বিষয়ে সাক্ষর বলা যাবে, সে বিষয়টি বেশ জটিল। আবদুশ শাকুর তাঁর সাংগীতিক সাক্ষরতা বইয়ে এমনই আলোচনার প্রসঙ্গ এনেছেন এবং শ্রোতার শ্রবণের পরিপক্বতার একটি মাত্রা নির্দেশ করেছেন। সংগীত বিষয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা থেকে শুরু করে তিনি উচ্চাঙ্গ, নজরুল, রবীন্দ্রসংগীত, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের গানের পার্থক্য, যন্ত্রসংগীত ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। মোট ১০টি প্রবন্ধে সংগীতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাবলীল বয়ান উপস্থাপন করেন লেখক। প্রথম প্রবন্ধটিতে আলোচিত হয়েছে সংগীতের প্রাথমিক ও মৌলিক কিছু বিষয়। স্বর, শব্দ, ধ্বনি এবং সুরের ভেতরকার গূঢ় রহস্যের একটি প্রাঞ্জল বর্ণনা রয়েছে এখানে। তবে এ প্রবন্ধটির মূল জায়গা হলো সংগীতের সঙ্গে কথার সম্পর্ক। এর পরের প্রবন্ধটি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কন্যা অন্নপূর্ণা খাঁকে নিয়ে। ভারতবর্ষের শুদ্ধ সংগীতে যে কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় গুরু রয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্নপূর্ণা খাঁ অন্যতম। তাঁর জীবনের গভীরতম ট্র্যাজেডিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন লেখক। স্বামী রবিশঙ্করের চেয়ে ভালো বাজাতেন তিনি। বাবার মতোই বাজনার শুদ্ধতার প্রশ্নে কোনো আপস ছিল না তাঁর। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ নিজে বলতেন, ‘আমার বাজনা যদি কেউ বাজিয়ে থাকে, তবে সে আমার মেয়েই বাজিয়েছে।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বামীর কারণে তিনি নিভৃতিকেই বেছে নেন স্বেচ্ছায়, বদ্ধ ঘরে বসে একা একা বাজাতেন আর দু-একজনকে শেখাতেন। বাংলা গানের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি সাংগীতিক জীবনী তুলে ধরা হয়েছে এর পরের প্রবন্ধে। প্রবন্ধটির নামের মধ্যেই লেখক বলে ফেলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে তাঁর চূড়ান্ত কথাটি, ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান যেন অনায়াস শ্বাসপ্রশ্বাস।’ আসলেই তাই, হেমন্তের গান এত সাবলীল যে তাঁকে ‘অনায়াস শ্বাসপ্রশ্বাস’ হিসেবেই আখ্যায়িত করা সহজতর। হেমন্তের সময়ে নামকরা সব গায়কের মধ্যে কারো জায়গা করে নেওয়া রীতিমতো দুঃসাধ্যই বলতে হবে। ‘ধ্বনিসংস্কৃতি বনাম লিপিসংস্কৃতি’ প্রবন্ধটিতে আবদুশ শাকুর সংগীতের রেকর্ডের ইতিহাসটি তুলে ধরেছেন। ১৮৭৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর টমাস আলভা এডিসন প্রথম কোনো যন্ত্রে মানুষের কণ্ঠ রেকর্ড করেন। ১৯০১ সালে এই উপমহাদেশে এসেছে গ্রামোফোন কোম্পানি। এডিসন উদ্ভাবিত ‘টকিং-মেশিন’, যার হাতে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে রূপান্তরিত হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তিনি জার্মানির এমিল বার্লিনার। তার পরের বিবর্তনের ইতিহাসটি সবারই জানা। আজকের যুগে মিলিয়ন মিলিয়ন সংগীতের রেকর্ড সংগ্রহে রাখা প্রযুক্তির সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে কোনো ব্যাপারই না। ‘সাংগীতিক সাক্ষরতা’ প্রবন্ধে লেখক বেশ মজার ভাষায় অজ্ঞ ও রসিক শ্রোতার নানাবিধ কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন। আজকের দিনে একজন মানুষকে কেন সংগীত বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা আবশ্যক, তার একটি চমৎকার ব্যাখ্যা রয়েছে এখানে। উপমহাদেশের গ্রামোফোন রেকর্ডের প্রথম শিল্পী হিসেবে গওহরজানের নাম উচ্চারিত হলেও আবদুশ শাকুর তথ্যপ্রমাণসমেত দেখান, প্রকৃতপক্ষে প্রথম শিল্পী হিসেবে গ্রামোফোন কোম্পানি যার গান রেকর্ড করে তিনি শশিমুখী। তবে গহওরজানের কিংবদন্তিতুল্য জীবন ও প্রতিভাকে তুলে ধরেন লেখক। পাশাপাশি শশিমুখীর আলোচনাও আসে তাঁর ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণেই। মূলত শুদ্ধ সংগীতের নানাবিধ বিষয় নিয়ে লেখক অনবদ্য এক পরম্পরা নির্মাণ করেছেন তাঁর সাংগীতিক সাক্ষরতা বইয়ে। সংগীতের সমঝদার মানুষের সংগ্রহের রেকর্ডের পাশাপাশি এ বইটি স্থান পেতে পারে নির্দ্বিধায়।