User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির সমস্ত সত্তাজুড়ে; আমাদের আনন্দ-বেদনা, সংগ্রাম ও সাধনায় আমরা তাঁর শরণ নিই। তাঁকে আমরা পাঠ করি, ধ্যান করি, গীত করি—সবকিছুই আমাদের প্রয়োজনে। কখনো তিনি আমাদের চিন্তাচেতনা, ভাব ও ভালোবাসাকে আচ্ছন্ন করে থাকেন। আবার কখনো তাঁকে ভুলে যাই। লেখক-গবেষক-কবি আবুল মোমেনের রবীন্দ্রনাথ মুসলিম মানস ও বাংলাদেশের অভিযাত্রা বইয়ের শিরোনামটি দ্ব্যর্থবোধক। রবীন্দ্রনাথ মুসলিম মানসকে কীভাবে বুঝেছিলেন আর মুসলিম সমাজই বা কবির বিশাল সৃষ্টিকর্মকে কীভাবে আত্মস্থ করেছে, তার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন এটি। বাংলা সাহিত্যে যখন রবীন্দ্রনাথের অভ্যুদয়, তখন মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানের বিকাশ তেমনটা ঘটেনি; তাঁদের ক্ষুদ্র একটি অংশ অভিজাত নবাব-জমিদার-গোমস্তা শ্রেণীর, যাঁরা বাংলা ভাষা চর্চা করতেন না; নিজেদের বাঙালি বলেও পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত ছিলেন। আরেকটি শ্রেণী একেবারে নিম্নবর্গের, যাঁদের পেশাগত পরিচয় মূলত কৃষক। ঘটনাক্রমে সেই কৃষকের ‘হেফাজতকারী’ ছিলেন উচ্চবর্গের হিন্দু সম্প্রদায়। ফলে উনিশ ও বিশ শতকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বটি কেবল সামাজিক আচার এবং জাতপাতের ছুঁৎমার্গের মধ্যে সীমিত ছিল না; প্রবল অর্থনৈতিক বৈষম্য তাদের নৈকট্য স্থাপনের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমানের এই সমস্যাটি বুঝেছিলেন বলেই ‘সমকক্ষতার’ ওপর জোর দিয়েছিলেন; যদিও তাঁর সাহিত্যে মুসলিম সমাজের মৃদু উপস্থিতি নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন। ২০ শতকের সূচনায় বাঙালি মুসলমান যখন শিক্ষাসহ রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে সমকক্ষতার দাবি জানাল; তখন বাঙালি হিন্দু তা হূষ্টচিত্তে মেনে নিতে পারেনি। ফলে অগ্রসর বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে পশ্চাৎপদ বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক বৈরিতা বাড়তে থাকে এবং ভিন্ন রাষ্ট্রীয় পরিচয়েই তারা নিজেদের গন্তব্য বেছে নেয়। কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতিই যে মানুষের জীবনের সব নয়, পাকিস্তান আমলে বাঙালি মুসলমান সেই পরম সত্যটি অনুধাবন করে চরম মূল্য দিয়ে। শুরু হয় বাঙালি মুসলমানের আত্মানুসন্ধান; যেখানে রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে বড় আশ্রয় ও সহায়। ‘রবীন্দ্রনাথের পূর্ববঙ্গ এবং বাংলাদেশের অভিযাত্রা আররবীন্দ্রনাথ ও মুসলিম মানস: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ শিরোনামের প্রবন্ধ দুটিতে আবুল মোমেন যুক্তি ও তথ্যের নিরিখে এই সত্যটিই তুলে ধরেছেন। তাঁর ভাষায় ‘রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ-বর্জনে যে লড়াই বিভাগ পূর্ব ভাগে শুরু হয়েছে, তা এখনো চলছে।’ যদিও তাঁর গানই আমাদের জাতীয় সংগীত হয়েছে। রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে আমরা তাঁকে যতটা ব্যবহার করেছি; আমাদের চিন্তা, মনন এবং রাষ্ট্রভাবনায় তাঁকে ততটা অঙ্গীভূত করিনি বা করতে পারিনি। সেই সুযোগটি নিয়েছে বাঙালিত্ব-বিরোধী রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি। পরবর্তী প্রবন্ধ ‘বাঙালির স্বদেশ ভাবনা ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘কাল সমুদ্রে আলোর যাত্রী’, ‘বেড়ে ওঠার অবলম্বন’, ‘আমার সময় ও রবীন্দ্রনাথ’-এ বাঙালির জাতিসত্তা গঠন ও বিকাশে রবীন্দ্রনাথের যে অপরিসীম দান সে কথাটিই লেখক আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ‘রবীন্দ্রনাথের উৎসব ভাবনা ও প্রাসঙ্গিক প্রস্তাব’, ‘বাংলা নাট্যচর্চার ধারা ও রবীন্দ্র নাটক’, ‘বাংলা কবিতার পালাবদল ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘মানুষের বিকাশ ও রবীন্দ্র-শিক্ষাদর্শ’, ‘আমাদের সংকট ও রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা’র মতো বিষয়ানুগ রচনা তাঁর বিশালতা ও গভীরতা জানতে-বুঝতে সাহায্য করবে। মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশ ও হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কাছে রবীন্দ্রনাথ যে ভিন্ন গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে আবির্ভূত, তার ইতি-নেতি দুটো দিকই রয়েছে। রবীন্দ্রচর্চার এই দুই ধারা অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে যদি একই রেখায় মিলিত না হয়, তাহলে সংস্কৃতির ওপর রাষ্ট্র ও রাজনীতিই প্রভুত্ব করবে; বাংলার দুই অংশেই বাঙালিত্ব হয়ে উঠবে নিছক পাঠ-পঠন এবং আচারের বিষয়। তখন খণ্ডিত বাঙালি সত্তায় অখণ্ড রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করা কেবল দুরূহ নয়, অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ রকম চিন্তা-জাগানিয়া একটি বই উপহার দেওয়ার জন্য আবুল মোমেনকে আন্তরিক অভিনন্দন।