User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
অদিতির লেখা প্রথম পড়ি ১৯৯৯ সালে। গল্পগ্রন্থটির নাম ছিল ইমানুয়েলের গৃহপ্রবেশ। প্রতিটি গল্পেই নিরীক্ষার ছাপ স্পষ্ট। প্রথাগত রীতির বাইরে বেরোবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা বিষয় নির্বাচনে, বর্ণনায়, গল্পের কাঠামো নির্মাণে। একজন তরুণ তার লেখায় যে তীক্ষ পর্যবেক্ষণ দক্ষতা, গভীরে অনুসন্ধান আর বিশ্লেষণী শক্তির প্রখরতা দেখাতে পারছে, অনুভব করেছিলাম অদিতির লেখকসত্তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা প্রোথিত। তাঁর আরও লেখা পড়েছি এবং এখন অপৌরুষেয় ১৯৭১ পড়ে আমার সে ধারণা পোক্ত হলো। সাতটি গল্পের বইটিতে নাম গল্পটি (অপৌরুষেয় ১৯৭১) দীর্ঘ। আর একটু বিস্তার পেলেই যা উপন্যাস হয়ে উঠতে পারত। ৪০ বছর ধরে হুইলচেয়ার আঁকড়ে থাকা বাংলাদেশের নানা প্রান্তের কিছু যুদ্ধাহত মানুষ তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে বসে আর এক আহত যোদ্ধা মোদাচ্ছার হোসেন ‘মধু’র ডায়েরি পড়ছে। অল্প শিক্ষিত মধু এখন বেঁচে নেই কিন্তু ডায়রিতে লিখে গেছেন যুদ্ধোত্তর কালের এক অজানা অধ্যায়। তারই পাঠ চলছে। আর এই পাঠ ফুরোবার আগ পর্যন্ত ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে হাত, পা, চোখ, কানসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হারানো যোদ্ধা সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের মান্নান আলী, পাবনার কেয়ামুদ্দিন, সিলেটের মোহাম্মদ আব্দুল রকিব, রংপুরের নূর ইসলাম, দিনাজপুরের অনিল কান্তি রায়, নেত্রকোনার আবু সিদ্দিক, যশোরের শামসুর মণ্ডলরাও স্মৃতিকাতর হচ্ছেন, শোনাচ্ছেন যুদ্ধকালের গল্প, যুদ্ধোত্তর তাঁদের বেঁচে থাকার করুণ কাহিনি। গল্পটিতে দীর্ঘদিনের ধূলিমলিন ইতিহাসের আস্তাবল খুঁড়ে চলার এক অসাধারণ পরিকল্পনায় মেতেছিলেন অদিতি। তেষট্টি পৃষ্ঠাজুড়ে চলেছে এর বাস্তবায়ন। নতুন করে পাওয়ার বা হারানোর আর কিছু নেই যাঁদের—হয়তো একটা সনদ, কয়েকটা চিঠি, টুকরো কিছু কাগজ, যুদ্ধদিনের স্মৃতি, পঙ্গু শরীর আর বেদনার অসীম ভার বয়ে চলেছে যাঁরা বা এভাবে চলতে চলতে মরেই গেছেন, তাঁদের বয়ান...ফাঁকে ফাঁকে মধুর ডায়েরির পাতা থেকে পাঠ...৪০ বছরের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া...আমার দুঃখিনী বাংলার গল্পগাথা। ‘ইন্দুবালা’, ‘শিউলি ফুল’ ও ‘মাঘন ঋষির মৃত্য’ গল্পটি আমার বিবেচনায় এ গ্রন্থের সেরা গল্প। ঘোর লাগা বয়ানের চমৎকারিত্বে মুচিপুত্র মাঘন ঋষির বাপ ঠাকুরদা মিলিয়ে প্রায় তিন পুরুষকে আঠারো পৃষ্ঠায় বেঁধে ফেলেছেন অদিতি। যুদ্ধপূর্ব-যুদ্ধোত্তর এবং বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লেখা আমানুল্লাপুর গ্রামের জিয়ালি নলতাপাড়ার মুচিদের গল্পই শুধু নয় এটি—বাংলার প্রান্তবাসীর প্রতিবাদ প্রতিরোধ হতাশা ও আশার গল্প। জেগে ওঠা মানুষের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পালাবদলের গল্প। জাত-পাতের সংস্কারে আটকে থাকা নিচু তলার মানুষের আকাঙ্ক্ষায় ফোটা শিউলি ফুলের পদতলে নিষ্পেষিত হওয়ার আখ্যান। বর্ণনা আর কথনের ভাষা একাকার করে, সময়ের গণ্ডি ভেঙে ঢাকা, পিন্ডি, ভাসানী, মুজিব, আগরতলা মামলা, বাঙালি, মাউরা, বিহারি হয়ে নকশালি সন্ত্রাস এবং বিচারবহির্ভূত আজকের ক্রসফায়ারে এসে গল্পের ইতি টানেন অদিতি। গল্পকথনে, ভাষায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার যত কৌশলই থাকুক, এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমার ঘোলাজলে ইতিহাসের পরম্পরা যেমন বিচ্যুত হয় না তেমনি মুচি সমাজের সংস্কৃতি, তাদের দৈনন্দিন, তাদের ধর্মাধর্মও ওর তলায় চাপা পড়ে না— ‘রজকিনীর স্বামী মাত্র দু’দিন আগেই বিষ দিয়ে কায়েত পাড়ার একটি গরু মেরে লুকিয়ে তার চামড়া এনে উঠানে রেখেছিল শুকাবে বলে। বৃষ্টিতে সেই চামড়া এখন শুকায় কোথায়? অবস্থা এমন যে পোয়াতির আঁতুড় ঘরে ব্যথা উঠবার সময় থেকে বিয়োনো অবধি দু’দিন দু’রাত সমানে বৃষ্টি...আকাশ থেকে ঢল...যেন মা গঙ্গা সাক্ষাৎ শিবের জটা থেকে মর্ত্যে কুল প্লাবিনী হয়ে নেমেছেন...যেন গঙ্গার ধারা খোদ আকাশ থেকে সমানে বয়ে নেমে আঁতুড় ঘরে দাইয়ের জ্বালানো মাটির উনুন নিভিয়ে দেবে যে কোন সময়...ঘরে আনা একটি আস্ত গরুর কাঁচা চামড়ার গন্ধ রোদে শুকাতে না পেরে চারপাশের বাতাস ভারী করে তুলছে...অথচ দু’ গাঁ দূরের বাদ্যকর পাড়া থেকে রতন ঢুলি শুকনো চামড়ার ফরমাশ করে গেছিল... তেমন এক বৃষ্টির রাতে...আঘন মাসের সতেরো তারিখ মাঘন ঋষির বাবা আঘন ঋষির জন্ম হয়ে থাকবে বটে!’ ‘মাঘন ঋষি সন্ত্রাসী ছিল কি ছিল না সেটা বুঝতে আমরা স্থানীয় সংবাদপত্রের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ি, বারবার খবরটা মন দিয়ে পড়তে থাকি এবং তারপরও বুঝতে পারি না যে মাঘন ঋষি সন্ত্রাসী ছিল কি না, সন্ত্রাসী হয়ে থাকলে সে কতটুকু সন্ত্রাসী হয়ে থাকবে কিম্বা পুলিশের এই হত্যা ভুল কি সঠিক?’ গল্পটি এখানেই থেমে গেলে পারত। কিন্তু লেখক একে টেনে নিলেন। মাঘনের মা বউ মেয়ে দাদির জন্য পাঠকের অন্তর নিংড়ে বেদনা জাগাতে চাইলেন। এই বাড়তি অংশের চাপ সইতে কষ্ট হলেও বলব একটি অসাধারণ গল্প পড়েছি। গ্রন্থের আর একটি গল্প লতাটানা গান ও হাতি খেদার উপকথা। গারো পাহাড়ের হাজং সম্প্রদায়ের প্রেম ও বিদ্রোহের গল্প। মনা ও সুখমনি হাজংয়ের সেই উপাখ্যানের রেশ আরও প্রায় ১০০ বছর পর তাদের নাতি-নাতনিদের সময়ে টঙ্ক বিদ্রোহের সঙ্গে সূত্রবদ্ধ হয়েছে। যে কাহিনি অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে শোনাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গল্প শেষ করেছেন লেখক। এ ছাড়া বারগির, রেশম ও রসুন বোনার গল্প, পন্ডস ভ্যানিশিং ক্রিম ও সরলা কিঙ্কুর বিকেল, বলো আমার নাম লাল, স্বপ্ন সংহিতা নামের গল্পগুলোতেও সমকালের বিবিধ বিষয়কে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন লেখক। অদিতি প্রান্তীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি যেমন শ্রদ্ধাশীল। গল্পে সেসবের অনেক কিছুই হাজির করার চেষ্টাও করেছেন অতীতে, আলোচ্য গ্রন্থেও। কিন্তু অদিতির অন্বেষণ, অদিতির বিবেচনাবোধ উপচে নিরীক্ষাপ্রবণ গদ্য যখন তথ্যের কুলিগিরিতে মুহ্য হয়ে পড়ে আখ্যানের বোঝা পাঠকের জন্যও দুর্বহ হয়। তথ্য-উপাত্ত আর্টের নিরুপদ্রব চলনের উপযোগী না হলে অপচয়ের ওজন ঘাড়ে করে পাড়ে পৌঁছার দায় নিতে পারে কি না জানা নেই। প্রথম আলো বর্ষসেরা বই: ১৪১৭ মননশীল শাখা অদিতি ফাল্গুনীর অপৌরুষেয় ১৯৭১ শংসাবচন ‘ফাইলের পর ফাইল। এই বিশ্রামাগারে আমরা কিছু পূর্ণ বিকলাঙ্গ মানুষ দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে কত কাগজেই না জমিয়ে রেখেছি। আজকাল কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না যে আমরা যুদ্ধ করেছি। তাই জমিয়ে রাখি সব কাগজ। ভারতীয় হাসপাতালে চিকিৎসা হয়েছে এই মর্মে কাগজ, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের স্বাক্ষরিত কাগজ, সাব-সেক্টর কমান্ডার, কোম্পানি কমান্ডার...সবার চিঠি। অনেকের চিঠি আজকাল ঝাপসা হয়ে এসেছে।’ মুক্তিযুদ্ধে বিকলাঙ্গ হয়ে যাওয়া অজস্র মানুষের যেন বা প্রতিনিধি এমন এক মুক্তিযোদ্ধার দিনলিপির এই লেখা এমন এক সময়ের কথা বলে, যা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক টুকরো দলিল, অথচ আমরা বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি বলে সেই গৌরবের কিছুই এখন হূদয়ে ও স্মৃতিতে ধারণ করি না। এই লজ্জা ও গ্লানির কথাই লিপিবদ্ধ হয়েছে অদিতি ফাল্গুনী রচিত অপৌরুষেয় ১৯৭১ গ্রন্থে। অপৌরুষেয় ১৯৭১ গ্রন্থে সর্বমোট সাতটি রচনা সন্নিবদ্ধ হয়েছে। প্রতিটি গল্পই আবেগমন্দ্রিত ভাষায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কে চিত্রিত করে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সে এমন এক গৌরবোজ্জ্বল সময়, যা বিস্মৃত হওয়া ব্যক্তিগত পাপ ও জাতীয় অপরাধ বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য। আমরা বর্তমানে সেই ব্যক্তিগত পাপ ও জাতীয় অপরাধের মধ্যেই যেন নিমজ্জিত হয়ে পড়েছি। এ বইয়ের রচনাসমূহ যেন আত্মত্রাণের পথ দেখায়: আমাদের মনে করিয়ে দেয় কোন কোন প্রসঙ্গ বা বিষয় কখনোই ভোলা চলবে না। অদিতি ফাল্গুনীর অপৌরুষেয় ১৯৭১ আমাদের সাম্প্রতিক কালের সাহিত্যে অবিস্মরণীয় এক গ্রন্থ বলে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে।