User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
প্রেম-বিরহ-ভালবাসা, মধ্যবিত্তের জীবন সংগ্রাম, গ্রামীন-জীবনের স্নিগ্ধতা কিংবা শহুরে নাগরিক-জীবনের গতিময়তা, ইত্যাদি আমাদের সমকালীন সাহিত্যে ছোটগল্পের চিরায়ত প্লট। কিন্তু এই-সবকিছুর বাইরে বেরিয়ে একদম ভিন্ন ফ্লেভারে, বাস্তবতা-কল্পনা, ঘটনা-অঘটনার সম্ভাবনা আর ক্রিটিক্যাল থিংকিং-এর অদ্ভুত মিশেলে মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয় গড়ে তুলেছেন অনবদ্য কিছু ব্যতিক্রমী ছোটগল্প। কোনও ঘটনায় যা যা ঘটার সম্ভাবনা থাকে, সেইটুকু বাদ দিয়ে যতটুকু থাকে, মূলত ততটুকুই হচ্ছে তার গল্পের মূল প্লট। তার গল্পগুলো পাঠককে দেয় অনাবিল ভাবনার খোরাক, নিয়ে যায় চিন্তার ডুবসাঁতারে। . লেখক প্রত্যেকটা গল্পের ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহার করেছেন আমাদের চিরচেনা চারপাশকেই। কিন্তু ব্যতিক্রমী আর বৈচিত্র্যময় রঙে সেই ক্যানভাস-ই হয়ে উঠেছে অনন্য। এই বইয়ে গল্প রয়েছে মোট দশটি। আকারে প্রত্যেকটিই মাঝারি ধরনের। বিষয়বস্তুর নিরিখে প্রায় সব-কয়টিই আকর্ষণীয়। ভালোলাগার ক্রমানুসারে বলতে গেলে যে-গল্পটি সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে, সেটি হচ্ছে "ঢ়-তত্ত্ব"; লেখক এখানে প্রশ্ন তোলেন, সভ্যতা যেমন সামনে এগিয়ে যায়, তেমনি কি পিছনে ফিরে আগের বিন্দুতে মিশে যেতে পারে? "কিন্তু"-তে লেখক পিঁপড়ার মনোজগতের তাৎপর্যপূর্ণ এক প্রশ্নের উপস্থাপন করেন। "বরফ বিম্ব" দেখায়, আদতে আমরা সারাজীবন ধরেই বিশেষ একটা খেলনা খুঁজি, সেটা পেয়ে গেলেই চলে যাই; কিন্তু কোথায় যাই, সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। "ধাঁধায় দ্বিধা" আরেকটি চমৎকার গল্প; লেখক কল্পনা করেন এমন এক রাষ্ট্রের, যেখানে সব অপরাধের সমাধান হবে ধাঁধার মধ্য দিয়েই। "অমূলদ ডট ডট ডট" এর মূল বার্তা ব্যতিক্রমী না হলেও, কাহিনী ও উপস্থাপনা চমৎকার; লেখকের প্রশ্ন, কাকের পেছনে আসলে কী? "গ্রে স্কেচ" লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতারণার শিকার হওয়ার আক্ষেপপূর্ণ এক আখ্যান। "তৃতীয় বন্ধনী"-তে লেখক প্রশ্ন তুলেছেন, মানুষ কি চাইলেই তার গোষ্ঠীপ্রবণতাকে ছাপিয়ে যেতে পারে? "কর্মচারী যজ্ঞ" আমাদের ভাবায়, মহান মানুষেরা মহত্ত্ব থেকে আসলে কী পায়? "গল্প গবেষণা প্রকল্প" এ লেখক ছোটগল্পের নতুন কিছু কাঠামোর প্রস্তাব করেন, যেটা অনেকাংশেই উদ্ভট ঠেকেছে আমার কাছে। "গ্যাড ফ্লাই"-এ তেমন অভিনবত্ব নেই বললেই চলে, সাধারণ বিশ্বাস-অবিশ্বাস-ষড়যন্ত্রের গল্প। . বইয়ে লেখকের যে-বিষয়টি বিশেষভাবে মনোযোগ কাড়ে, সেটি হচ্ছে তার বর্ণনাশৈলী আর শব্দ-চয়নে অসামান্য দক্ষতা। কিছু কিছু জায়গায় লেখক তৈরি করছেন একদম নতুন, অভিনব, নিজস্ব কিছু শব্দ। তবে বর্ণনাশৈলী ও শব্দ-চয়ন দুটোই অসাধারণ হলেও, কিছু কিছু জায়গায় মনে হয়েছে লেখক অপ্রয়োজনীয় বাক্যের অতিব্যবহার করেছেন। এই দুয়েকটা জায়গার কথা বাদ দিলে, লেখকের বলার ভঙ্গি একেবারেই অনবদ্য। তাছাড়া, উল্লেখ করার মতো আরেকটা দিক হচ্ছে, প্রত্যেকটা গল্পের শেষে লেখক বলেছেন গল্প লেখার পূর্বপট, চিন্তা অক্ষরে রূপ নেওয়ার ইতিহাস। এইটুকু পাঠককে গল্প লেখাকালীন লেখকের মস্তিষ্কের কেমিস্ট্রিটুকু বুঝতে সাহায্য করে। . বইটি প্রকাশ করেছে আদর্শ। বইয়ের পৃষ্ঠার মান থেকে শুরু করে বাঁধাই, প্রচ্ছদ সব-কিছুই প্রশ্নাতীত প্রশংসার দাবিদার। বইয়ে বানান-সংক্রান্ত ভুলচুক চোখে পড়েনি কোনও। লেখক শব্দগঠনে কিছুটা স্বাধীন হলেও তাতে ভালোলাগা বৈ বিরক্তি আসে না। তাই সব মিলিয়ে দারুণ-ই বলা চলে। . বইটির বিষয়বস্তু যেহেতু চিরায়ত সাহিত্যের বিষয়ের সাথে সমরৈখিক নয়, তাই অনেকেরই হয়তো বিরক্তি আসতে পারে। এজন্য বলা ভালো- এই বইটা সবার ভালো লাগবে না। তবে ধীরে ধীরে লেখকের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে নিজের মধ্যে আত্তীকরণ করে এগোতে পারলে, পাঠক মস্তিষ্কের কোটরে এক নতুন ধরনের দোলার টের পাবেন। সেই দোলা আপনাকে নিয়ে যাবে হিমালয়-এর চিন্তারাজ্যের বীক্ষণ প্রান্তে। বীক্ষণ প্রান্ত মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়
Was this review helpful to you?
or
এবইয়ের গল্পগুলো চিন্তার দেয়ালে কিছু প্রশ্ন রেখে যায়,মনের দু-একটা দরজা খুলেও যেতে পারে।নিজস্ব চিন্তাগুলোকে তুলে ধরতে লেখক গল্পের আশ্রয় নিয়েছেন।রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা নিয়ে চিন্তাভাবনা কমবেশি সবলেখকই করেন। কিন্তু একে ছোটগল্পের পরিসরে রূপ দেবার দুঃসাহস করন খুব কমই। 'ধাঁধায় দ্বিধা' ও 'ঢ়-তত্ত্ব' তেমনই ২টি গল্প। ঢ়-তত্ত্ব গল্পের প্লটটা আমার ধারণা, একটি চমৎকার উপন্যাস দাবি করে।'কর্মচারী তত্ত্ব'-সাধারণ ধাঁচে শুরু করা একটি গল্প কীভাবে শেষমেশ অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে---তার চমৎকার নিদর্শন এই গল্পটি।'কিন্তু' গল্পটাও দারুন।সমাজতত্ত্ব নিয়ে আরেকটি দারুণ গল্প '৩য় বন্ধনী'। তাঁর শব্দ চয়ন দেখে মনে হয়েছে প্রচলিত প্রথাকে ভাঙার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।আসলে গল্পগুলোকে হ্যান্স এন্ডারসনের রূপকথার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যারা গল্পের শরীরে নিছক 'কাহিনী' না খুঁজে অন্য কিছুর সন্ধান করেন,তারা এই গ্রন্থটি পড়ে দেখতে পারেন।বইটিতে লেখক মানব জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রকে সচেতনভাবে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরতে চেয়েছেন এবং সফলও হয়েছেন।
Was this review helpful to you?
or
বীক্ষণ প্রান্ত আমার পড়া হিমালয় ভাইয়ের দ্বিতীয় বই, মাঝখানে তার একটি অনুবাদ বের হয়েছে, সেটা পড়া না হলেও তার প্রথম বইটি কিনে পড়া হয়েছিলো। পাঠক হিসেবে আমি বেশ কিপ্টে প্রকৃতির, নতুন লেখকদের বই খুব একটা পড়া হয় না, এর পেছনে আমার যে চিন্তাটা কাজ করে, তা হলো, এখনো অনেক অনেক ভালো লেখকের অসাধারণ সব লেখা আমার অপাঠ্য রয়ে গেছে। আমার বোধকরি সেগুলোই আগে পড়ে ফেলা উচিত। তো এই বৃত্ত থেকে বের হয়ে কেমন কেমন করে যেন একদিন “বীক্ষণ প্রান্ত” কেনা হয়ে গেলো, অনেক গুলো “ক্যাওস থিওরি” এর প্রতিক্রিয়াশীল ফলাফল বলা যেতে পারে। তারপরে একটা সময় কেনো যেন মনে হলো, রিভিউ লেখাটা খারাপ হয় না। সত্যিকার অর্থে বলতে, প্রতিযোগিতার জন্য আমার এই রিভিউ লেখা না। আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বেশ কিছু বিষয়, যা বই পড়তে গিয়ে আমার কাছে খটকা লেগেছে, অনেক কিছুই দুর্বোধ্য মনে হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে রূপক বিষয়টি আপাত অর্থে কি বোঝায় যা বুঝতে আমি অপারগ হয়েছি, এইগুলো নিয়ে হিমালয় ভাইয়ের সাথে আলোচনা করবো। রিভিউ এর বিষয়টি চলে আসাতে তা সমাধান হয়নি, তবে আলোচনার বিষয়বস্তু যা হতে পারতো, তার প্রতিফলন এখানে স্থাপন করার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। একটু বলে রাখি, পাঠক হিসেবে আমি একান্তই যাচ্ছেতাই, আমি এমন প্রকৃতির পাঠক, যে বইয়ের কভার দেখে বই বিচার করি, লেখকের নাম দিয়ে বই বিচার করি, এবং ক্ষেত্রবিশেষে লেখকের ব্যাক্তিস্বত্বাও আমার পঠনে প্রতিক্রিয়া ফেলে। সুতরাং, রিভিউ অবশ্যই কোনো নির্দিষ্ট আদর্শের মাপকাঠিতে সাজানো নেই, বরং অনেকটাই আমার নিজ চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত। একদম গোড়া থেকেই শুরু করা যাক। পেপারব্যাক বইয়ের ফ্রন্ট কভারের উলটো দিকেই রুবেল ভাইয়ের কিছু কথা ছিলো। সে অংশটুকু বেশ ভালো লেগেছে। তার মতে, এখানে অনেকটা মজলিসের আয়োজন করা হয়েছে, তার মধ্যে স্থান করে নেওয়াটা অনেকটা পাঠকের নিজের দায়। এ বিষয়টুকু নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে, পাঠকের কাছে পৌছানোটা লেখকের দায়িত্ব, পাঠকের লেখকের ভাব অন্তরঙ্গম করাটা শুধুমাত্র বোধ করি জনপ্রিয় লেখকদের ক্ষেত্রেই খাটে, কাজেই বলতেই হবে, বইয়ের লেখক এবং মুখবন্ধের লেখক এক্ষেত্রে একরকমই সাহসই দেখিয়েছেন। সাহসের মাত্রাটা কম/বেশি এটা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে লেখকের নিজের চিন্তাটাকে তুলে ধরা। কাজেই এই ক্ষেত্রে একজন লেখকের অবস্থানের সাপেক্ষে চিন্তা করলে, লেখকের মূল উদ্দেশ্যে সফল। এবার গল্প প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রথমেই বীক্ষণ প্রান্তের আদ্যন্তের দিকে চোখ গেলো, নামগুলো দেখে একটু অনিয়মিত পাঠকদের ভড়কে যাওয়া স্বাভাবিক। নামগুলো ঠিক নিয়মিত নয়। আমার ব্যাক্তিগত মতামত হচ্ছে, লেখক এ ক্ষেত্রে তার সম্পূর্ণ নিজের স্বাধীনতা ব্যাবহার করেছেন, কোনো রকম নির্দেশনা অনুসরণ না করেই, প্রত্যেকটি গল্পে একটি গল্পমানচিত্র আছে, যা গল্পের ভাবটাকে সহজবোধ্যভাবে প্রকাশ করার পরিবর্তে উলটো বিভ্রান্তি আরো বাড়িয়ে দেয় বলেই মনে হয়েছে। তবুও, নামকরণের ভঙ্গিমা এবং গল্পমানচিত্রের বক্তব্য আমার ভালো লেগেছে। সব কিছুই খুব স্পষ্ট হবার প্রথা কোথাও নেই বলেই আমার জানা। রিভিউ মানে গল্পের প্রত্যেকটি লাইনের অর্থ, কি বুঝিয়েছে, এরকম কিছুর আলোচনা, আমার কাছে তা মনে হয় না। কাজেই আমি রিভিউ প্রসঙ্গে আমার যা বক্তব্য, সেটা একজনের কাছে সম্পূর্ণতা লাভ করবে যদি তার গল্পটি মাত্রই পড়া হয়, অথবা বীক্ষণ প্রান্ত বইটি এবং আমার রিভিউ, এই দুটো পাশাপাশি নিয়ে বসা হলে। প্রথম গল্পের নাম “কিন্তু”। এখানে প্রথমে পিঁপড়া কলোনীর একটি স্বাভাবিক সমাজব্যাবস্থার চিত্র স্থাপন করা হয়েছে, তারপরে সেখানে কিছু চরিত্র নিয়ে কাজ করা হয়েছে,। মূল চরিত্র ষৎকো নামের একটি পিঁপড়া, তার চিন্তাভাবনা এবং কার্যক্রমের চিত্রই মোটামুটি পুরো গল্প জুড়ে। গল্পে ষৎকোর চারপাশ এবং তার চিন্তাধারার অনুসারী হয়ে বেশ কিছুটা সম্মোহিত হয়েই পড়েছিলাম গল্পটা। একটা পর্যায় পর্যন্ত গল্প চলে যাবার পর চিরায়ত একটা অনুভূতিও ফিরে এসেছে, সামনে কি হবে তা জানার চেষ্টা। কাজেই শেষমেষ যখন গল্পটা একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে শেষ করে দেওয়া হয়েছে, আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। গল্পটা অই অংশের একটু আগে, বা একটু পরে শেষ হলেও আমার কাছে এটি পরিপূর্ণতা পেতো না। গল্পের বিবরণী স্পষ্ট, সাবলীল এবং গতিশীল, এবং ক্লোজিং এক কথায় চমৎকার। গল্পের মূলভাব স্পষ্ট মনে না হলেও, গল্পাশ্রমে ভ্রমণ অংশের আলোচনা থেকে থেকে কিছুটা ধারণ লাভ করা যায়, এবং আমার গল্পটি সম্পর্কে আমার নিজস্ব অনুমিত বিষয়গুলো কাছাকাছি থাকাতে আমার বেশ ভালোই লেগেছে। এরপর ধাঁধায় দ্বিধা নামক গল্পটি। গল্পের প্রায় পঞ্চাশ ভাগ জুড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে, একটা আদর্শ সমাজ ব্যাবস্থা যেভাবে হওয়া উচিত, লেখক এই ব্যাপারে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনা এখানে এক এক করে স্থাপন করেছেন। পুরো বিষয়ের ধারণাটি খুবই চমৎকার, গল্পের খাতিরে হলেও বাস্তবায়নের পথে দূরত্বটা খুব বেশি না। যে কারণে সমাজকে আরো কয়েক ধাপে উন্নত করার চিরায়ত যে চিন্তা সবার মধ্যে ঘোরে, সেটির সাথে সমান্তরাল বলে প্রথমেই গল্পটি মনযোগ নিয়ে নেবে বলে আমার ধারণা। এরপর গল্পের মূল চরিত্র, পানচেনির জীবনে তার অপরাধ, তার জন্য শাস্তি, এবং ধাঁধা নিয়েই বাকি অংশটুকু। ধাঁধার অংশটুকু পাঠকের মনযোগ ধরে রাখবে পরেরটুকুতে, এবং প্রথম অংশের জন্য সমাজ ব্যাবস্থার যে চিত্রায়ণ, সেটি তো আছেই, এই দুইটি বিষয়ই আমার ক্ষেত্রে মনযোগ ধরে রাখতে পুরোপুরি সক্ষম! যদিও গল্পের কিছু ক্ষেত্রে বিস্তৃত ব্যাখা, সংজ্ঞায়ন বিরক্তিকর লেগেছে, তবে অই অংশটি বাদ দিয়ে, এবং বাদ না দিয়ে গল্পের অর্থ এবং পাঠ্যানুভূতির কোনো হেরফের হয় না। গল্পের শেষাংশে সমাপ্তির অংশটুকুও ভালো লেগেছে, সুতরাং, আমি বলবো, গল্পটি এক কথায় চমৎকার। এই গল্পের গল্পাশ্রমে ভ্রমণ থেকে মনে হলো, গল্পটি বিরাট মাত্রায় চমক ভাইয়ের অংক দাদুর ধারণা দ্বারা অনুপ্রাণিত। তবে অংক দাদু থেকে সম্পূর্ণ আরেকটি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে গিয়ে গল্পকে প্রতিস্থাপনের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব হিমালয় ভাইয়ের। ৩য় বন্ধনী গল্পের ক্ষেত্রে আমার অনুভূতি একটু অন্যরকম, গল্পকে একটা পর্যায়ে গিয়ে অযথা লম্বা করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। গল্পের অর্থ শেষমেষ কি দাঁড়ায়, বুঝে উঠতে পারি নি। তৃতীয় বন্ধনীতে আবদ্ধ লেখকের বক্তব্য প্রথমদিকে মজা লাগলেও পরে গিয়ে বিরক্তিকর মনে হয়েছে। মোটমাট গল্পের কোনো সামগ্রিক অর্থ দাড় করিয়ে উঠতে পারি নি। তবে প্রচলিত বিবাহ প্রক্রিয়া এবং তদ-সংক্রান্ত বিষয়ে লেখকের যে অনেক চিন্তাভাবনা আছে, এটি পরিষ্কার! গল্পাশ্রমে ভ্রমণ এই ক্ষেত্রে খুব বেশি সহায়ক কোনো কিছু হিসেবে দাড়াতে পারেনি। অমূলদ ডট ডট ডট গল্পটি এদিক থেকে আমার সম্পূর্ণ বিপরীত। গল্পের ভাষাশৈলী একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের পরে ভালো লাগেনি। কিন্তু গল্পের থিম চমৎকার লেগেছে। শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের ধারণাটি গল্পে নতুন একটা মাত্রা তৈরি করেছে। গল্পাশ্রমে আশ্রম থেকে মূল গল্পটি অনেকটাই সরে এসেছে, তবে তাতে গল্পের সৌন্দর্য বেড়েছে। লেখনী পরের ক্ষেত্রে আরো শক্ত হলে গল্পট অনবদ্য হতে পারতো। তবে এতো কিছুর পরও, ভালো লেগেছে। গ্রে স্কেচ কোনো গল্প নয়, অনেকটা নিজের মেমোয়ার্স হিসেবেই প্রতিফলিত হয়েছে, যারা কোনো না কোনো সৃজনশীল কাজে কখনো না কখনো সংযুক্ত ছিলো, আমার ধারণা সবারই মধ্যে এই ধরনের একটা চিন্তাভাবনার প্রতিফলন রয়েছে। হিমালয় ভাই লেখক, তার ক্ষেত্রে মিলান কুন্ডেরা, আমার ক্ষেত্রে হয়তো অন্য কেউ... কিন্তু সামগ্রিক অর্থের বিচারে, অনেকগুলো মানুষের সমন্বিত পরিবেশ এখানে চিত্রিত হয়েছে। ফলাফল, লেখার ধরণ এবং গল্পের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও, এটা প্রকৃত অর্থে আমাদের অনেকেরই গল্প। এ জন্য লেখার সাথে তরতরিয়ে এগিয়ে গিয়েছি, এবং মন্তব্য, ভালো লেগেছে। বরফবিম্ব পড়তে বিরক্ত লেগেছে, গল্পের আদ্যোপান্ত কোনো অংশই ভালো লাগে নি। অনর্থক জটিলতা তৈরির একটা চেষ্টা মনে হয়েছে, গল্পের ভেতরের শিরোনামের নামকরণ, গল্পের বর্ণা, ধারাবাহিকতার লেশমাত্রের অনুপস্থিতি মোটামুটি আমার জন্য অপাঠযোগ্য ছিলো, সুতরাং কোনোমতে একবার পড়ে শেষ করে ভুলে গিয়েছি, কাজেই এই প্রসঙ্গে আর কিছু বলার নেই। লেখকের এ বিষয়ে আরেকটু যত্নবান হওয়া উচিত। পাঠকের বিরক্তি উৎপাদন কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। কর্মচারী যজ্ঞের গল্পটি আরো সুন্দর হতে পারতো, ছোটখাটো অনেকগুলো ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ ছিলো বলে আমার বিশ্বাস। কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খুটিনাটি যোগ করে গল্পের আবেদনটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। গল্পটির বৈচিত্র্য কম, এবং নেয়াহেতই সাদামাটা। কিন্তু এই প্লটেই লেখক অনেক কাজ করতে পারতেন বলে আমার বিশ্বাস। গল্প গবেষণা প্রকল্প আমার এই বইয়ের পঠিত সবথেকে ভালো লাগার অংশটুকু। পুরো লেখাটা আমি একাধিকবার তন্ময় হয়ে পড়েছি, গল্পে নতুন অনেক কিছু ছিলো বলে, একসাথে অনেকগুলো সমতলের সমন্বয় হয়েছে বলে। পুরোটা সম্পর্কে এক কথায় বলবো, অনবদ্য। এমন লেখা হাজারবার পড়েও ক্লান্তি নেই। গ্যাডফ্লাই গল্পটিতে আকর্ষণ খুজে পাইনি খুব বেশি। প্রথমদিকে আগ্রহ নিয়েই পড়েছি, একটা পর্যায়ে গিয়ে অতীত টেনে আনা, চরিত্রগুলোর স্বাভাবিক কদর্যতার প্রকাশ, খুব বেশি গতানুগতিক, নতুন কোনো কিছু চোখে পড়েনি যার জন্য গল্পে সেটে থাকতে হবে। গল্পের গাথুনি বা ধারাবাহিকতায় অনাকর্ষণীয় একটা ভাব চোখে পড়েছে, এ গল্প আমি সমস্য কাটানোর জন্য একবার পড়তে পারি, তবে দ্বিতীয়বার পড়বো না। ঢ়-তত্ত্ব আমার বিচারে এই বইয়ের দ্বিতীয় শ্রেষ্ট লেখা। পুরো গল্পটি আমি তন্ময় হয়ে পড়েছি, একাধিকবার। গল্পেটা অনেকটা বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর ধাঁচের, বিশাল একটা সমাজ ব্যাবস্থার সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া এবং সচল মিথষ্ক্রিয়া দেখেছি। গল্পের ভবিষ্যত যদিও লেখকের হাতে, তারপরও একটা পর্যায়ে নিজের মত করে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করতে হয়। পাঠককে দিয়ে গল্পের উপাদান ছন্দবদ্ধ করতে পারাটা আমার মনে হয় লেখকের জন্য বিরাট প্রাপ্তি, এবং এই ক্ষেত্রে উনি সফল। সুতরাং, পুরো বইটিতে ভালো লাগার বিষয় আছে, বিরক্তি উৎপাদনের বিষয় আছে, একেবারে নিরীহ ধাঁচের এগিয়ে যাওয়া গল্পও আছে। লেখার অনেকগুলো জায়গাতে লেখকের যথেচ্ছাচারীর প্রভাব স্পষ্ট, সেটার কারণে গল্প কখনও কখনও আকর্ষণ হারিয়েছে বলে মনে হয়েছে। লেখকের ছাপ স্পষ্ট রেখে এ জায়গাগুলোতে আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আরেকটি ব্যাপার হলো, বীক্ষণ প্রান্ত পড়বার আগে লেখক হিমালয় হিমু সম্পর্কে আমার খুব বেশি আগ্রহ ছিলো না। মনে হতো, তার লেখনী এমন কোনো একটা স্তরে, যে স্তর সম্পর্কে আমার খুব বেশি আগ্রহ কখনই জন্মাবে না। কিন্তু বইটি পড়ে আমার অভিমত অনেকাংশেই পরিবর্তিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে আমি তার ভবিষ্যতের লেখাগুলোর জন্য নির্ধারিত পাঠক হয়ে গেছি। লেখকের সর্বাঙ্গীন কামনা করি। লেখা চলুক। সমালোচনা চলুক। গঠনমূলক কিছু না আসলেও চলবে, ভালো কিছু আসুক। ধন্যবাদ।
Was this review helpful to you?
or
মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয় তাঁর 'বীক্ষণ প্রান্ত' বইটিতে ভিন্নধারার একটি স্বাদ আনতে পেরেছেন তাঁর লেখনীর । বইটি অন্য সকল রচনা থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী । বইটিতে খন্ডচিত্রের মাধ্যমে লেখক রুপক আকারে বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরেছেন । তার এই লেখনীতে তিনি ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে মানবসমাজ ও মানবজীবনকে তুলে ধরেছেন । তিনি উপমাপ্রয়োগের দ্বারা বুঝিয়েছেন পাঠকদের । যেমন তিনি প্রথম গল্পের দ্বারা পিপড়ার জীবনযাপনের মাধ্যমে মানুষজাতিকে পরিশ্রমী ও সফলতার মন্ত্র শিখিয়েছেন । তেমনি একটি গল্পে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উপস্থিত হওয়া সমস্যাকে ধাধার সাথে তূলনা করেছেন এবং সমাধানে উন্নতির পথ বাতলে দিয়েছেন । তেমনি তার লেখনীতে অনেক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায় যা পাঠকদের ভিন্ন স্বাদ এনে দেয় । পাঠকদের ভিন্ন ধারার লেখনীর সাথে পরিচয় ঘটাতে লেখনীটি অসাধারন । সবাই নিশ্চই উপভোগ করবেন এটি । এটা রিভিউ এর অংশ নয় । [রিভিউ কখনোই অতি বৃহত্ হতে পারেনা এবং তাতে সকল বিষয় উঠে আসতে পারেনা । তাই নাট্যকলার ছাত্র হিসেবে লিখলাম আমার মত করে । তবে সকলের লেখা দেখে মনে হল পুরো গল্পটা না পড়ে রিভিউ পড়লেই হবে ।]
Was this review helpful to you?
or
লেখক মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়ের 'বীক্ষণ প্রান্ত' বইটি বাংলা সাহিত্য জগতে এক নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে |এই বইটিতে দশটি চিন্তাউদ্রেককারী ছোটগল্প স্থান পেয়েছে |এর প্রতিটি গল্পেই মানবচরিেএর বিভিন্ন দিক,মানবসমাজের চিহ্নিতকারী বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছে |ভিন্নস্বাদের এই বইটির প্রতিটি গল্পই স্বতন্তভাবে পাঠকদের আকৃষ্ট করবে |চিন্তার ক্ষেেএ নতুন কিছুর সন্ধানে,নতুন কিছু জানার আগ্রহ যাদের সবসময় তাদের জন্য এই বইটি আশানুরুপ |গল্পগুলোতে লেখক কল্পনাশ্রয়ী সম্ভাবনা করেছেন যা পাঠককে অনুপ্রাণিত করবে |প্রথম গল্প 'কিন্তু' |এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিএ ষৎকো নামক একটা পিপড়া |সে সাধারণ জীপন যাপন করত |কিন্তু হঠাৎ করেই সে কলোনির নামপ্রধান হয়ে যায় এবং তার মনে পিপড়া সম্প্রদায়ের উন্নত জীবনযাপনের ইচ্ছা জাগে |সে ইচ্ছাকে জয় করার প্রয়াসে ষৎকো দেয়াল বেয়ে হেঁটে চলে |'ধাধার দ্বিধা' গল্পে লেখক একটি আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা কল্পনা করেছেন |এই গল্পে লেখক অসংখ্য ধাধার সমাধানের মাধ্যমে নতুন পরিপূর্ণ সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মানের স্বপ্ন দেখেছেন |যারা আমরা বদলে যাওয়া রাষ্ট্রসমাজের কথা ভাবতে ভালবাসি তারা অবশ্যই এই কল্পনাশ্রয়ী গল্পটি পরে আনন্দ পাবেন এবং উৎসাহিত হবেন |'৩য় বন্ধনী' শব্দের মাঝে কেমন যেন একটা গন্ধ পাওয়া যায় |মনে হয় কি যেন অনেকদিন ধরে আটক হয়ে আছে |এই গল্পের কাহিনী গড়ে উঠে জহরুলের ছেলে শরিফুলের বিয়েকে কেন্দ্র করে |জহরুল তার ছেলের বিয়ে বিনা যৌতুক,দেনমোহরে করাতে চায় |কিন্তু সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির কাছে সে হেরে যায় |এই বইয়ের গল্পগুলোতে ভক্তি,আশা,স্বার্থপরতা স্থান পেয়েছে |আমি যখন বইটি পড়ছিলাম আমার মনে হয়েছে আমি গল্পের সাথে মিশে যাচ্ছি |মনে হল আমি নিজেই এসব দৃশ্যের স্বাক্ষী |আমার মত যারা নতুনকে জানতে আগ্রহী তাদেরকে বীক্ষণ প্রান্তে ঘুরে আসার দাওয়াত রইলো |
Was this review helpful to you?
or
"বইটা না পড়লে অনেক কিছু মিস করবেন..." __ সাদিদ মাহমুদ
Was this review helpful to you?
or
chomotkar boi shomporke ar ki bolbo. Ashole boi ta akbar pore oti madhabi baktio bojbe kina amar shondeho. Tobe manosher chinta jogot onek bishal.tai ami bolbo boita pore ak ak jon ak ak rokom kolpona korbe.
Was this review helpful to you?
or
এতদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল গল্প মানে বোধহয় মধ্যবিত্তের জীবন কাহিনী, আর নয়তো গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা। এসব কিছুর ধার না ধেরে পুরোপুরি অন্যরকম ফ্লেভারেও যে এভাবে গল্প লেখা যায় ভাবতেও পারিনি। সবচেয়ে ভাল লেগেছে ‘কিন্তু’ গল্পটা। পিঁপড়া হেলানো দেয়ালের শেষ সীমা পার হলেই ফড়িং হতে পারবে, সেই বিশ্বাসে এত কষ্ট করে উপরে উঠছে; এমনভাবে চিন্তাও করিনি। ধাঁধায় গল্পটাও অনেক ভাল লেগেছে। পুরো গল্পটা পড়ার সময় ঘোরের মধ্যে ছিলাম। মনে হচ্ছিল গল্পের ঐ দেশটা সত্যিই যেন কোথায় আছে। ৩য় বন্ধনী গল্পে থার্ড ব্র্যাকেট আর সেকেন্ড ব্র্যাকেট ব্যবহারের আইডিয়াটা মারাত্মক, তবে গল্পটা অত অভিনব কিছু লাগেনি। অমূলদ ডট ডট ডট পড়ে বিস্মিত হয়েছি। আলফা, বিটা, গামা এর বিটা; সেই বিটা আকৃতির গাছ, তার উপরে কাক বসার উপক্রম করতেছে, কাকটার নখে ধরা ম্যাগনিফাইং গ্লাস। বিটা আকৃতির গাছের নিচে পাথরের এপিটাফ, তাতে আবার তিনটা ডট। পুরা মাথা নষ্ট প্লট। বরফবিম্ব গল্পের প্লটও মাথা খারাপ করা। কর্মচারী যজ্ঞ পড়ে অনেক চিন্তা করেছি। সত্যিই কি মহত্ত্ব ব্যাপারটি এরকম তরল? গল্প গবেষণা প্রকল্প পড়তে গিয়ে ভয় পেয়েছি; এত হিসাব করে গল্প লেখা যায়। গ্যাডফ্লাই গল্পটা টানেনি। তবে ঢ়-তত্ত্ব ভীষণ অভিনব একটা গল্প। সভ্যতা আবার ইউটার্ন নিবে, এটা থিওরি হিসেবেই শুনেছি; প্র্যাকটিকালিও হতে পারে, চিন্তা করে দেখিনি। যাহোক, বইটা আমাকে ভীষণ আনন্দ দিয়েছে। আমি তুমি এর বাইরেও যে গল্প হতে পারে বাংলা ভাষায়, লেখক অত্যন্ত কনফিডেন্টলি তা করে দেখিয়েছে।
Was this review helpful to you?
or
আমরা খুব স্বাভাবিকভাবেই বই পড়ার কথা ভাবলেই বিখ্যাত লেখকদের বইয়ের কথা ভাবি। আমাদের কি ‘মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়’ এর মত নতুন লেখকদের সুযোগ দেয়া উচিৎ নয়? লেখকের লেখা দশটি গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে ‘বীক্ষণ প্রান্ত’ । প্রথম গল্প ‘কিন্তু’।কিন্তু’ একটি কল্পনাশ্রিত,আধুনিক রূপকধর্মী গল্প।‘ষৎকো’ নামের এক পিঁপড়া এ গল্পের প্রধান চরিত্র।ষৎকোর বিপ্লবের গল্প নিয়েই বেড়ে উঠেছে ”কিন্তু” গল্পটি।স্বতন্ত্র পরিচয়ের উদ্দেশ্যে ষৎকো তার দল নিয়ে কলোনী ছেড়ে আচমকা একদিন বেরিয়ে পড়ে জাদুর জগতের খোঁজে। শেষ পর্যন্ত সে একাই ফড়িং হবার অনন্ত পথে উঠতে থাকে।এখানে লেখক পিপড়ের মাধ্যমেই মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিকের প্রকাশে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। দ্বিতীয় গল্প "ধাঁধায় দ্বিধা"।"ধাঁধাঁয় দ্বিধা" গল্পে লেখক মানুষকে শুদ্ধ করার এক অভিনব পন্থার কথা বলেছেন।সেজন্য পরিবর্তন দরকার সমাজব্যবস্থা, প্রশাসনব্যবস্থা আর শিক্ষাব্যবস্থার।এই গল্পে লেখক মূলত অসংখ্য ধাঁধাঁ সমাধানের মাধ্যমে নতুন, পরিপূর্ণ সমাজ এবং রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন।পুরো বিষয়ের ধারণাটি খুবই চমৎকার, গল্পের খাতিরে হলেও বাস্তবায়নের পথে দূরত্বটা খুব বেশি না। তৃতীয় গল্প ‘৩য় বন্ধনী’।শরিফুল রিংকিকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়।সে তার বাবা জহুরুল আর মাকে রাজিও করায়। কিন্তু হঠাৎ করেই শরিফুলের বাবা জহুরুল বেঁকে বসেন।তিনি চান তার ছেলের বিয়েতে কোন স্বর্ণের আদানপ্রদান হবে না, কোন দেনমোহরের ব্যাপার থাকবে না।এর প্রধান কারণ শেষ বয়সে এসে নতুন আঙ্গিকে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ। ৪র্থ গল্প “অমূলদ ডট ডট ডট” শহরের রাস্তায় মৃত একটি কাকের পড়ে থাকার মাধ্যমে চমৎকার কাহিনী বিন্যাস নিয়ে শুরু হয়েছে। রথমে মোবাইলে এসএমএস, ই-মেইল, ফেস্টুন, দেয়াল লিখন এবং তারপর সারা শহরের পোষ্টারে “so, what is behind the Crow” লেখা কাকের ছবিযুক্ত একটি বিজ্ঞাপণ পুরো শহরে হইচই ফেলে দেয়। জোর তদন্তের পর বিজ্ঞাপণটির কর্ণধার “ল্যাম্বডা গ্রুপ”-এর এমডি’র বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর শুনানিতে বেরিয়ে আসে বিজ্ঞাপণটির পেছনের চমকপ্রদ উদ্দেশ্য। শিশু অধিকারে সচেতন এই গ্রুপটির পরবর্তী ব্যবসায়িক সাফল্য এবং সামাজিকভাবে উদ্দেশ্যটির প্রতিফলন দিয়ে গল্পের শেষ পাঠককে ভাবিয়ে তুলবে। ৫ম গল্প ‘গ্রে স্কেচ’ ।অনুবাদক হিসেবে তিনি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন মিলান কুন্ডেরার সঙ্গে। মিলান কুন্ডেরার উপন্যাস অনুবাদ করে গল্পের নায়ক যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন এবং পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়েছেন তা সংঘাতের মূল কারণ। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও প্রকাশনার সমূহ সংকট তাকে প্রতিশোধ প্রবণ হতে সহায়তা করেছে। একজন নতুন লেখক যেভাবে অবহেলা ও প্রতারণার শিকার হন তা এই গল্পে সহজে উঠে আসলেও সমাপ্তিটা চমৎকার- প্রতিশোধ নেয়ার কৌশলটা অভিনব। পরের গল্প ‘বরফবিম্ব’।লেখক এই গল্পে রওনক মিশকাত নামক একটি চরিত্রের মাধ্যম।মানুষ আসলে কীসের খোঁজে পৃথিবীতে এসেছে এমন প্রশ্ন ভাবায় পাঠককে! পরের গল্প ‘কর্মচারী যজ্ঞ’।মহৎ মানুষ অপরের মহত্মকেও সম্মানের চোখে দেখবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজীবন মহৎ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মানুষটার কি বিবেকবোধ লোপ পেতে পারে না? সে কি তার মহত্বকে ধরে রাখতে কখনো কখনো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে না? এমনই এক কাহিনী নিয়ে এই গল্প। হাশেম এবং প্রান্তিক চাষী ময়নাল এ দুজনের পারিবারিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে আগায় ‘গ্যাড ফ্লাই’ । হাশেমের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও শত্রুতা উদ্ধারের প্রচেষ্টা গল্পকে রাজনীতির পাঠে রূপান্তরিত করে। ভার্সিটি পড়ুয়া অনুপ ও হাশেমের সাক্ষাত যেন গ্রামীণ ও অভিজাত রাজনৈতিক চিন্তার মেলবন্ধন ও তুলনামূলক চিত্র। শেষটায় গ্যাট ফ্লাই হাশেমকে চট করে গরুর লেজ বানিয়ে পাঠককে চমকে দেয় লেখক। দিন দিন জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি এবং সাথে সাথে প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের ক্রমহ্রাসমান অবস্থায় একটি দেশের কি পরিস্থিতি হতে পারে তা রুপক অর্থে লেখক গল্পে তুলে ধরেছেন শেষ গল্প- “ঢ়-তত্ত্ব” গল্পে । তাই বলব পড়েই দেখুন না হয়তো নতুন লেখককে সুযোগ দিতে গিয়ে নিজেকেই সুযোগ দিলেন একঘেয়েমি কাটানোর ।। :)
Was this review helpful to you?
or
রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে অস্তিত্ববাদের মাতাল কারিগর মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পর আক্তারুজ্জামান ইলিয়াসের মনোসামাজিক অন্তর্দ্বন্দ আর ঘোরলাগা বর্ণনার আঞ্চলিক খিস্তিখেউড়ের পথে হঠাৎ করেই আবির্ভাব ঘটে নিম্নবিত্তের জীবনঘষা রুপকার খেয়ালী হাসান আজিজুল হকের। সাথে আরও কিছু সমসাময়িক পথিক নিয়ে কিছুটা শ্লথ গতিতে এভাবেই এগিয়ে চলছিল বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শাখা- ছোটগল্পের ট্রামগাড়ী। তারপর দুম করে ভূতের গলির জাদুকর শহীদুল জহিরের আচমকা উত্থানে ছোটগল্প বাঁক নেয় সম্পূর্ণ নতুন এক গতিধারায়। তারপর, হালের মনজুরুল ইসলাম কিংবা শাহাদুজ্জামানের মুগ্ধতায় ভ্রমণ করতে করতেই দেখা পেলাম কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী পথে চলার দু:সাহস দেখানো গল্পকার মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়ের। যদিও এটি তার প্রকাশিত ২য় গল্পগ্রন্থ, তবুও, বইয়ের যত গভীরে গিয়েছি ততই উন্মীলিত হয়েছে বই পিপাসু হিমালয়ের অসংখ্য বই পড়ার ঝোঁক, বই নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা এবং অসম্ভব কল্পনাশক্তির প্রমাণ। “কিন্তু” শিরোনাম নিয়ে প্রচন্ড দূরদর্শী এক গল্প দিয়ে শুরু হয়েছে বইটি। পিঁপড়াদের কলোনীতে খাদ্য সংগ্রহ ইউনিটের প্রধান ‘ষৎকো’ নামের এক পিঁপড়াকে কেন্দ্র করে এগিয়ে গেছে গল্পের বিন্যাস এবং পরিণতি। বৈষম্য, সৃষ্টিপ্রক্রিয়া আর নির্ধারিত জীবনযাপনে বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ ষৎকো পিঁপড়াদের এক স্বাধীনজীবি দলের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তার কিছু অনুসারী নিয়ে বিপ্লবের এক আত্মনাশী পরিকল্পনা করে। স্বতন্ত্র পরিচয়ের উদ্দেশ্যে ষৎকো তার দল নিয়ে কলোনী ছেড়ে আচমকা একদিন বেরিয়ে পড়ে জাদুর জগতের খোঁজে। শেষ পর্যন্ত সে একাই ফড়িং হবার অনন্ত পথে উঠতে থাকে। সে ভাবে, “চলতে চলতেই একদিন না একদিন পাওয়া যাবে জাদুর জগতের শেষ প্রান্ত, এবং তারপর সে হবে ফড়িং...” বস্তুত: পিঁপড়ার মত ক্ষুদ্র একটি প্রাণীর মাধ্যমে লেখক আমাদের মানব জীবনের ক্ষোভ, বৈষম্য, বিপ্লব আর সর্বজনীন আকাঙ্খাকে চমৎকার দর্শন থেকে তুলে ধরেছেন। প্রথম গল্পই আমাকে ভেতরের পাতায় অনায়াসে টেনে নিয়ে যায়। গল্পগ্রন্থের ২য় গল্প “ধাঁধায় দ্বিধা”, “অকাল্পনিক অতিশয়”, “অবশিষ্টের অভিলাস”, “অনি:শেষে অবিরাম”-এরকম চমৎকার দ্বৈত শব্দের উপশিরোনাম দিয়ে ভাগ করা হয়েছে কাল্পনিক এক দেশের অসম্ভব সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার গল্পটি, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘আলভেরি পানচেনি’। ১৫ বছর বয়সে পানচেনির একটা অপরাধ করার মধ্য দিয়ে গল্পের যাত্রা শুরু। সেই কাল্পনিক অদ্ভুত রাষ্ট্রে জন্মের পর থেকে শুরু করে প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষা গ্রহণ, সামাজিক ও ধর্মীয় মুল্যবোধ প্রভৃতি নাটকীয়ভাবে বা খেলাচ্ছলে শেখায় হিউম্যান রিসোর্স স্কুল। পাপ, অন্যায়, অপরাধের আলাদা সংজ্ঞায়ন শেষে তাদের অদ্ভুত অথচ কার্যকর বিচার ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। সে আইনে যে কোন ধরনের অপরাধের শাস্তি হচ্ছে নির্দিষ্ট ধাঁধা সমাধান করা। পানচেনির কৃত অপরাধের দরুণ তার নির্দিষ্ট ধাঁধা সমাধানের কাহিনী নিয়েই গল্প এগিয়ে গেছে। একসময় দেখা যায় পানচেনি ধাঁধা সমাধানে খুব মজা পেয়ে যায় এবং আরও অপরাধ করতে থাকে। চিন্তিত রাষ্ট্র পরিশেষে তাকে অপরাধে নিবৃত্ত না হতে দারুণ একটা উপায় বের করে। গল্পটিতে গল্পকার আমাদের রাষ্ট্রীয় অবক্ষয়, দুর্নীতি, শিক্ষা সংকট কিংবা হাস্যকর বিচার ব্যবস্থাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। গল্পগ্রন্থের ৩য় গল্প “৩য় বন্ধনী”। “তিনি জহুরুল বলেই মানুষজন হয়তো বিস্মিত অথবা বিরক্ত হচ্ছে”- লাইনটা দিয়ে শুরু হওয়া পাঠককে ভেতরে টেনে নেয়ার এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র জহুরুল। তার ছেলে শরিফুলের পছন্দ করা মেয়ের সাথে বিয়ে এবং পরবর্তীতে বিয়েতে কোন রকম অনুষ্ঠান না করার সিদ্ধান্তের জটিলতা নিয়ে গল্প বিন্যাসের দিকে এগিয়ে গেছে। পৌরসভার খোকা মিয়া এবং জহিরুলের মধ্যে প্রায়ই বিয়ের যথার্থতা নিয়ে কথা হয়। পাড়ায় জহিরুলকে নিয়ে একটি গুজব নিয়ে গল্প নাটকীয়তায় মোড় নেয়। ফলশ্রূতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে শরিফুলের বিয়ে হয়। বিয়েতে খোকা মিয়ার তরফ থেকে পাঠানো কিছু অদ্ভুত উপঢৌকন উন্মোচনের মাধ্যমে গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটে। গল্পে খোকা মিয়ার সাথে জহিরুলের ‘বিয়ে’ বিষয়ে যুক্তিপূর্ণ বিতর্ক লেখকের নিজস্ব মতবাদকে প্রকাশিত হতে দেখি আমরা। ২য় ও ৩য় বন্ধনীর মাধ্যমে লেখক গল্প পড়তে পড়তে পাঠকের মনের উদ্ভূত সম্ভাব্য প্রশ্ন ও তার রসালো জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন, যা গল্পের সাবলীল প্রবহমানতাকে কিছুটা বিচ্যুতি ঘটিয়েছে বলে মনে হয়েছে। শহরের রাস্তায় মৃত একটি কাকের পড়ে থাকার মাধ্যমে চমৎকার কাহিনী বিন্যাস নিয়ে শুরু হয়েছে ৪র্থ গল্প “অমূলদ ডট ডট ডট” । প্রথমে মোবাইলে এসএমএস, ই-মেইল, ফেস্টুন, দেয়াল লিখন এবং তারপর সারা শহরের পোষ্টারে “so, what is behind the Crow” লেখা কাকের ছবিযুক্ত একটি বিজ্ঞাপণ পুরো শহরে হইচই ফেলে দেয়। জোর তদন্তের পর বিজ্ঞাপণটির কর্ণধার “ল্যাম্বডা গ্রুপ”-এর এমডি’র বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর শুনানিতে বেরিয়ে আসে বিজ্ঞাপণটির পেছনের চমকপ্রদ উদ্দেশ্য। শিশু অধিকারে সচেতন এই গ্রুপটির পরবর্তী ব্যবসায়িক সাফল্য এবং সামাজিকভাবে উদ্দেশ্যটির প্রতিফলন দিয়ে গল্পের শেষ পাঠককে ভাবিয়ে তুলবে। জনপ্রিয় পশ্চিমা সাহিত্যিক মিলান কুন্ডেরা’র একটি বইয়ের অনুবাদনকে ঘিরে রচিত হয়েছে ৫ম গল্প- “গ্রে স্কেচ”। “আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং” বইটি অনুবাদ করতে গিয়ে জনৈক অনুবাদকের দীর্ঘ পরিশ্রম, অপরিসীম ধৈর্য্য আর ত্যাগ অনুবাদককে কুন্ডেরার সাথে মানসিক বিরোধে জড়িয়ে পড়তে হয়। শেষে, অনুবাদকের চাতুরীর কাছে মিলান কুন্ডেরার পরাজয় ঘটে। গল্পের অনুবাদকটি সম্ভবত লেখক নিজেই-একথা বারবারই পাঠকের মনে হবে। সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি রচনা, মোটাদাগে চিন্তার একটি মোক্ষম গল্প- “বরফ বিম্ব”। চেতনার জগত, চেতনাপূর্ব এবং পরবর্তী অবস্থান, এ দু’য়ের মধ্যবর্তী আস্তরণ ও একীভবন নিয়ে কনক মিশকাত নামের চরিত্রকে কেন্দ্র করে আত্মা, ঈশ্বর আর বাস্তবতা নিয়ে বেশ পরিশ্রমী একটি গল্প এটি; যা পিপাসু এবং ভিন্ন স্বাদের পাঠককে মোহিত করবে। গ্রন্থটির ৭ম অন্তর্ভুক্তি আরেকটি প্রাঞ্জল গল্প- “কর্মচারী যজ্ঞ”। গল্পে খামারবাড়ির কর্তা আফসার আহমেদ, নিয়ামত, সোবহানের স্ত্রী মালেকা, পরিচারিকা বিলকিস, একাব্বর কিংবা মিসেস আফসারের পৃথক জবানিতে দেখা যায় কেয়ারটেকার সোবাহান খামারবাড়ির একমাত্র বিশ্বস্ত লোক। এতে করে আফসার আহমেদ অতৃপ্তিতে ভোগেন প্রায়ই। কারণ সোবাহান থাকাতে তিনি পুরোপুরিভাবে কর্তৃত্ব করতে পারছেন না; তিনি সম্পূর্ণভাবে দৃশ্যপটে থাকতে চান। এরপর সোবাহানের বিরুদ্ধে কুৎসিত এবং মারাত্মক সিদ্ধান্তটি কার্যকর ও পরবর্তীতে আফসার আহমেদের নিষ্ফল অনুশোচনা দিয়ে শেষ হয় গল্পটি। গল্পটির ব্যতিক্রমী উপস্থাপন, কাহিনীর সাবলীলতা ও ঘটনার আকস্মিকতা গল্পটিকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছে। গ্রন্থের আর একটি ভিন্নধর্মী রচনা “গল্প গবেষণা প্রকল্প”। শিরোনাম দেখেই বুঝা যায় এটি একটি গবেষণামূলক লেখা যা সংখ্যার মাধ্যমে গল্প রচনার ক্ষেত্রে দিক নির্দেশনা। লেখক এখানে নির্দিষ্ট সংখ্যার গন্ডিতে কিছু গল্প লেখার চেষ্টা বা উৎসাহ যুগিয়েছেন। যেমনঃ ৭ শব্দ সংখ্যার গল্প- “সেই শেষবার, এরপর কখনোই আর দেখিনি তাকে”, এটিও যে গল্প হতে পারে লেখক তা দেখিয়েছেন। এরকম আরও সংখ্যাভিত্তিক গল্পবিন্যাস করে তিনি প্রস্তাব করেছেন এভাবে গল্প লেখা যায় কিনা। যদিও সংখ্যা দিয়ে গল্পের সীমানা বেঁধে দেয়া যায় না, তবুও লেখকের এ পরিশ্রমী প্রকল্প প্রশংসার দাবি রাখে। মফস্বলের এক বাড়ির ড্রইংরুমের আধানষ্ট একটা ফ্যানের বর্ণনা দিয়ে চমৎকারভাবে শুরু হয়েছে অন্যরকম একটি গল্প- “গ্যডফ্লাই”। রুমে বসা দুই রকম চরিত্রের দুজন মানুষ- ময়নাল এবং হাশেম। তারা আসে আবিদা বেগমের কাছে মামলা থেকে বাঁচার পরামর্শ নিতে। ধনী হাশেমের বড় ছেলের বৌ, নিরীহ ময়নালের মুদি দোকানি ছেলের সাথে চলে যাওয়ার পর তারা আসে বুদ্ধি নিতে। আবিদার ছেলে অনুপের সাথে কথা বলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে আমরা দেখি চতুর এবং দূরদর্শী হাশেমের বাগ্মীতা, জ্ঞান ও কনভিন্স করার কৌশলী দক্ষতা। আবিদার সাথে পরে কথা বলার পর উন্মোচিত হয় হাশেমের এখানে আসার প্রকৃত ও ভয়ঙ্কর উদ্দেশ্য। গল্পের শেষে তাইতো মাছির প্রসঙ্গে হাসেমের একটি কথায় তার রুপ উঠে আসে- “এই যে হাতখান দ্যাকতাচেন,এইডা হইলো গিয়া গরুর ল্যাজ;এমুন কইরা বাডি মারুম যে মাছির চৌদ্দগুষ্টি ধারেকাছে ঘেষতে পারবে না”। গ্রন্থের শেষ গল্প- “ঢ়-তত্ত্ব”। গল্প মানচিত্রে লেখক আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন এটি একটি আষাঢ়ে গল্প! দিন দিন জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি এবং সাথে সাথে প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের ক্রমহ্রাসমান অবস্থায় একটি দেশের কি পরিস্থিতি হতে পারে তা রুপক অর্থে লেখক গল্পে তুলে ধরেছেন। একটি গোত্র বা জনপদের ধীরে ধীরে আদিম যুগে ফিরে যাওয়ার কারণ তিনি অত্যন্ত নিপুণভাবে কলমের ডগায় তুলে এনেছেন। এটিকে আষাঢ়ে গল্প বললেও সত্যি সত্যি এটি আমাদের ভাবনার রসদ যোগায়। চমৎকার উৎসর্গ করা বইটির শুরুতে গল্প মানচিত্র এবং প্রতিটি গল্পের শেষে উপভোগ্য “গল্পাশ্রমে ভ্রমণ” বইটির ‘ইউনিকনেস’ বাড়িয়েছে। এছাড়া বইটির ভিন্নধর্মী কাভার, প্রচ্ছদ এবং বাঁধাই পাঠককে আগেই ব্যাতিক্রমী স্বাদ নেয়ার আমন্ত্রণ জানায়। সর্বোপরি, “বীক্ষণপ্রান্ত” বইটি ধরতে হবে চরম দুঃসাহস নিয়ে এবং একবার ধরার পর পাঠকের করোটিতে বাসা বাঁধবে ভাবনার ডাহুক পাখি; ফুসফুসের চোরাপথে নিঃশ্বাসের সাথে ক্রমশঃই বেড়ে উঠবে অন্য অ্যাডভেঞ্চারের মোহ । পাঠকের সামনে উন্মীলিত হবে অবহেলার অতীত, আসন্ন ভবিষ্যত কিংবা নৃশংস বর্তমানের স্লাইড করা প্রতিচ্ছবি। বাংলা সাহিত্যে চলমান ছোটগল্পের এই আকালের গোধূলীবেলায়, মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়ের এই অল্প পাঠকের গল্প ধরার দুঃসাহসী চ্যালেঞ্জকে একজন নগন্য পাঠক হিসেবে আমি স্বাগত জানাই।
Was this review helpful to you?
or
বইয়ের ফ্ল্যাপটা অসাধারন হয়েছে। বইটা যখন পরতে শুরু করলাম কোন ভাবেই বইটা রেখে উঠতে পারলাম না। আমি মনে করি বইটি সময় উপযোগী হয়েছে। বইটি অনেক বিশ্লেষনধর্মি বই। আমার অনেক ভাল লেগেছে। আমার পক্ষ থেকে লেখক সহ যারা এই বইটির শুভাকাঙ্খি সকলকে ধন্যবাদ।
Was this review helpful to you?
or
গণিতের ইতিহাস জুড়ে দেখা যায় ‘পাই’-এর মান নির্ভুলভাবে নির্ণয়ের ব্যাপক চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি, এই ধরণের প্রচেষ্টা কখনও কখনও সংস্কৃতির অংশও হয়েছে। এই অমূলদ পাইকে ব্যাখ্যা করা সহজ। আবার অন্যদিকে কঠিনও। সংখ্যাতত্ত্ব দিয়েই লেখাটি শুরু করলাম। কারণ আছে। ব্যক্তির নাম ‘হিমালয় পাই’। ব্লগের জগতে এ নামেই পরিচিত। গল্পের তুমুল সমালোচক হিমালয় পাই। আমিও নিজে মাঝে মাঝে ভাবতাম এ মানুষটিকে ব্যাখ্যার মধ্যে আনা সম্ভব না। অবশ্য পৃথিবীর সব মানুষের চরিত্রই অনেকটা পাইয়ের মতো। যাইহোক, রহস্যমাখা চরিত্র। চুপচাপ, পাগল-টাগল টাইপ মানুষ হিমালয় পাই (ব্যক্তিগত মতামত)। যা ভাবে তা নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার সাহস বুকে রাখে। হিমালয় পাই নামটা সামনে এলে এ চরিত্রই মাথায় ঘুরপাক খায়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি ওনাকে তেমন চিনি না। অনলাইন বা ভার্চুয়াল চেনাজানা। এর বেশি কিছু না! 1186295_10201823727853088_435720795_nতার গল্পগ্রন্থ ‘বীক্ষণ প্রান্ত’। এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১০ টি গল্প। বইটি’র ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো- প্রতিটি গল্পের শেষে লেখক ‘গল্পাশ্রমে ভ্রমণ’ লিখেছেন। তার অর্থ হলো, গল্প লেখার প্রেক্ষাপট লেখক তার পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করেছেন। এ বিষয়টিতে আগ্রহ তৈরি হতে পারে। পাঠক যখন গল্প পড়েন তখন তার মধ্যে আগ্রহ জন্মায়- লেখক ঠিক কোন প্রেক্ষাপটে গল্পটি লিখলেন। এ বিষয়গুলো লেখকরা সাধারণত রহস্যের মধ্যেই রেখে দিতে পছন্দ করেন। কিন্তু বীক্ষণ প্রান্ত গল্পগ্রন্থে দেখা গেল হিমালয় তার গল্প লেখার প্রেক্ষাপট কিংবা অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। যেমন, লেখক একটি দৃশ্য বারবার কল্পনা করেন। একটি পিঁপড়া দেয়াল বেয়ে উপরে উঠছে, যে দেয়ালটির কোনো শেষ নেই। মিউজিক ভিডিও বানাতে গিয়ে এ দৃশ্যটির কথা ভাবেন লেখক। কিন্ত সে দৃশ্যটি মিউজিক ভিডিওতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করা যায় পিঁপড়া বিষয়ক ভাবনা থেকেই লেখক লিখে ফেলেন গল্প ‘কিন্তু’। গল্পে দেখা যায় পিঁপড়াদের সমাজ। সে সমাজের নিয়ম নীতিও লিপিবদ্ধ করেন লেখক। পিঁপড়াদের নিয়েও আইন কানুন থাকতে পারে, তাদের দেশ থাকতে পারে, পাড়া থাকতে পারে- এ সব বিষয়গুলো অত্যন্ত দক্ষভাবেই গল্পে তুলে আনেন হিমালয়। এ গল্পের প্রধান চরিত্র ষৎকো। ষৎকোর বিপ্লবের গল্প নিয়েই বেড়ে উঠেছে ”কিন্তু” গল্পটি। মজার বিষয় হলো পিঁপড়ার জীবনের সঙ্গে কোথায় যেন মিল পাওয়া যায় আদি-মানুষের জীবনের। কলোনীর গণ্ডির ভেতর ষৎকো থাকতে চায়নি। সে বিপ্লব করে চলে যেতে চেয়েছে। নিয়মের বাইরে একটি স্বাধীন জীবনের আশায় ষৎকো এক পর্যায়ে বিপ্লব করে বসে। খাদ্য ইউনিটের প্রধান হওয়ার আগ পর্যন্ত অবশ্য তার কোনো নামও ছিল না। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ছিল ষৎকো। কিন্তু ইউনিট প্রধান হয়ে একটি নতুন জীবনের স্বাদ পায় ষৎকো। পিঁপড়ার ভেতর যেন লেখক মানব জীবনের ছাপ প্রবেশ করানোর এক সূক্ষ্ম চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। যাইহোক, ষৎকো জীবনের অর্থ, সার্থকতা খুঁজতে থাকে। শ্রেণী বিদ্বেষ, অর্থনীতি সবকিছুই প্রবেশ করানো হয় পিঁপড়াদের জীবন ধারণে। মানুষের মধ্যে যেমন ষড়যন্ত্রকারী থাকে, পিঁপড়াদের সমাজেও থাকে। বিপ্লবীও থাকে। এসবই তুলে আনার চেষ্টা করেছেন লেখক। পিঁপড়াদের মধ্যে দেশ ধারণার ফিলোসফিও বোঝার চেষ্টা করেছেন লেখক। এ সম্পর্কে লেখক তার দর্শন উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, পিঁপড়াদের ‘দেশ ধারণা’ ওদের শরীরে মতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। দেশ বলতে ওরা বুঝে কলোনীর সীমানাটুকুই; কলোনীর বাইরে বেরুলেই ওরা দেশান্তরী হয়। যে কারণে প্রতি কদমেই পিঁপড়া নতুন দেশ অবিষ্কার করে। কলোনীর আশেপাশে কয়েক কিলোমিটার জায়গায়ই ওদের পৃথিবী। পিঁপড়ারা এক জীবনে তাই অগুনিত পৃথিবী আর অফুরন্ত দেশে বসবাস করে। এ গল্পে এক পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই, পিঁপড়ারা স্রষ্টাকেও সন্ধান করে। সৃষ্টির দর্শন নিয়েও ভাবে। যে ধান গাছের গোড়ায় তাদের কলোনী সেই ধান গাছই তাদের স্রষ্টা। এভাবেই নানান জিজ্ঞাসার মধ্যে দিয়ে গল্পের শেষে ষৎকোকে একটি দেয়াল বেয়ে উপরে চলে যেতে দেখা যায়। অন্য জীবনের সন্ধানে ষৎকো যাত্রা শুরু করে। সৃষ্টি রহস্যের সন্ধানে ষৎকোর যাত্রা সঙ্গীরা একে একে ফেরত চলে যায়। কিন্তু ষৎকো অবিরামভাবে যেতেই থাকে। এ যেন এক মানব জীবনের যাত্রা। পিঁপড়ার জীবনের ভেতর মানব জীবনের দর্শন বোধ খুব নিপূনভাবে ঢুকিয়ে দিলেন লেখক মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়। মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়হিমালয়ের প্রতিটি গল্পে অন্যরকম স্বাদ আছে। সে সব গল্প নিয়ে ভাবে সূক্ষ্মভাবে, ইচ্ছে মত গল্পকে চালাতে পারেন। দরকার মতো চরিত্রগুলোকে বদলে দিতে পারেন। কখন নায়ক কখনও খলনায়কও বানিয়ে দিতে পারেন। এমনই একটি চরিত্র দেখা যায় ‘গ্যাড ফ্লাই’ গল্পের হাশেম চরিত্রের মধ্যে। গল্পের শুরুতে আবিদা আখতারের প্রশাসন অফিসে হাশেমকে দেখা যায়। হাশেমকে শুরুতেই গ্রামের ধনীদের অন্যতম চরিত্র হিসেবে দেখা যায়। যার দুই ছেলে থাকে মালয়েশিয়াতে। তাদের টাকা দিয়েই গ্রামে টাকাওয়ালাদের তালিকায় নাম লিখিয়েছে হাশেম। তার দুই ছেলের বউরা গ্রামেই থাকে। বেশ কয়েকবছর ছেলেরা দেশে আসে না। এ সুযোগে প্রান্তিক চাষী ময়নালের মুদি দোকানি ছেলের সঙ্গে হাশেমের বড় ছেলের বউয়ের অনৈতিক সম্পর্ক দেখা যায়। এখানে যৌনতা খুব চাপানোভাবেই লেখক প্রবেশ করান। ভাষা মার্জিত রেখে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেন। তবে এসব চরিত্র গল্পের ভেতর আশেপাশের গল্প। এসব ঘটনা শুধু হাশেমকে বুঝতে সহায়তা করতে পারে। এর বেশি কিছু নয়! বড় ছেলের বউ কিংবা ময়নালের ছেলের চরিত্রের কোনো বর্ণনা নেই। সেগুলো’র দরকারও নেই। কারণ গ্রামের বিচারের পরপর ময়নালের ছেলে এবং হাশেমের বউ পালিয়ে যায়। কোথায় যায় তারা? সে কথাও স্পষ্ট করেননি লেখক। তাদের গল্প থেকে নিজ হাতেই গোপনে পাঠিয়ে দেন। প্রেমিক-প্রেমিকার জীবনে হাশেমকে নিয়ে ঝামেলা বাধাতে চায়নি লেখক। কিন্তু এসব ঘটনায় ফেঁসে গেছে প্রান্তিক চাষী ময়নাল। তার ছেলে কোথায় লাপাত্তা হয়েছে, সে জানে না। তবুও সে মামলায় ফেঁসে গেছে। এদিকে ৭ বছর যাবৎ নির্বাচিত মেম্বার কাজলের সঙ্গে বিবাদ শুরু হয় তার। তার হুমকি-ধামকি, নানান সমস্যায় জর্জরিত হয়েই আবিদা আখতারের কাছে ধরনা দেন হাশেম। গল্পের এতো সব ঘটনার মধ্যে হাশেমকে গ্রামের উঠতি ধনীদের মতো খারাপ লোক হিসেবেই দেখা যায়। কিন্তু হুট করেই চরিত্রটি বদলাতে শুরু করে আবিদা আখতারের ছেলে অনুপের সঙ্গে আলাপচারিতার সময়। শহরে বেড়ে ওঠা অনুপকে নিজের নানান দর্শনের কথা শোনান হাশেম। ঠিক তখনই বদলে যায় হাশেম চরিত্র। তার দর্শনের ভেতর ঢুকে লেখক বলেন, …৪২ বচর একখান দ্যাশের জন্যে কিচুই না। একটা জাতির নিজেগো স্টাইল তৈরি হইতেই তো ১০০ বচর লাগে। দুর্নীতি কও, দলাদলি কও- ব্যাপারডিরে লাগে বৃষ্টির লাহান। যহন জোরে বৃষ্টি পড়ে, রাস্তা-ঘাট ডুইবা যায়, ছাতা বাইর হওন যায়না, মাগার আমরা জানি এই বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকপো না। মাগার যহন পুলাপানের মুতের লাহান টিপটিপ কইরা বৃষ্টি পড়ে, সেইডা কিন্তু সহজে শ্যাষ হয় না। অনুপ মুগ্ধ হয় হাশেমের কথায়। পাঠকরাও মুগ্ধ হবেন। তখন আর হাশেমের মতো মানুষগুলোকে খারাপ মনে হবে না। তারা হয়ে উঠবে অন্যরকম দার্শনিক মানুষ। তাদের জীবন ধ্যান-জ্ঞানে গেঁয়ো কিন্তু ভেতরে থাকে স্বচ্ছ জীবনবোধ। হাশেমের মতো লোকগুলোর সঙ্গে লেখক তুলনা করেন অনুপের ভার্সিটির বন্ধু-বড় ভাইদের সঙ্গে। এ সম্পর্কে লেখক গল্পে উল্লেখ করেন, … শ্রেণীশত্রু, সামন্ত, প্রভু, পুঁজিপতি নিপাত যাক, গ্রামকে জাগিয়ে বিপ্লব করবে- কত কথা সেইসব বড় ভাইয়ের মুখে শোনা যেত। সুন্দর সুন্দর কথা বলা সেসব মানুষ এখন বিপ্লব করে বহুজাতিক কোম্পানিতে শ্রম বিক্রির মাধ্যমে; সকালে বেরোয়-সন্ধ্যায় ফেরে বিধ্বস্ত হয়ে, আর ছুটির দিনে বাড়িতে শুয়ে-বসে পরের দিনের শ্রমের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। সূর্যের দেখা পায় না মাসের পর মাস।… গল্পে চালাক চতুর হাশেমকে এক পর্যায়ে বোকা বানায় আবিদা আখতার। বোঝা যায় শহুরে মানুষ জটিলতা বোঝে। জটিলতার কাছেধারে গেলেও কোথাও যেন অনভিজ্ঞ থেকে যায় হাশেমের মতো চরিত্রগুলো। হিমালয়ের গল্পের অন্যরকম বিষয় হলো- গল্প একটানে পড়া যায় কিন্তু একমুহূর্ত অমনোযোগী হওয়া যায় না। গেলেই শেষ! গল্প থেকে ছিটকে যেতে হবে। এক্ষেত্রে কয়েকটি গল্প ‘ধাঁধাঁয় দ্বিধা’, ‘৩য় বন্ধনী’, ‘বরফবিম্ব’, ‘ঢ়-তত্ত্ব’ অন্যতম। গল্পের পাঠক হিসেবে বলতে পারি, এধরনের গল্প সব ধরনের পাঠক টানবে না। যারা গল্প নিয়ে ভাবতে মজা পান তাদের জন্য এগল্পগুলো ব্যাপকভাবে চিন্তার খোরাক হবে। এবার আসি আমার প্রিয় দুটি গল্পের আলাপে। গল্পগুলো হলো, ‘অমূলদ ডট ডট ডট’ এবং ‘গ্রে স্কেচ’। অমূলদ ডট ডট ডট গল্পের কনসেপ্টের ভেতর হোসে সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’-এর কথা মনে পড়ে। শহরে অন্ধত্ব রোগ দেখা দেয়। আস্তে আস্তে সারা শহরের সবাই অন্ধ হতে শুর করে। অনেকটা এমনই এক কাক নিয়ে শুরু হয় শহরজুড়ে আলোচনা। শহরের সবার মোবাইলেই এক এসএমএস আসতে দেখা যায়। যেখানে লেখা- so, what is it behind the Crow? শহরে একটি কাকের ছবি আর উক্তিতে ভরে যায়। ব্যানার, ফেস্টুন, দেয়ালে পোষ্টারে ভরে যায়। 481612_10201061034826239_1769361800_nযেখানে একটি কাকের ছবি এবং ঠোট বরাবর উক্তি লেখা- so, what is it behind the Crow? পাঠককে এক অন্যরকম জগতের ভেতর নিয়ে যাবে এ গল্পটি। পাঠক ভাবতে থাকবে- হয়তো পিঁপড়ার মতো এটিও কোনো এক কাকের গল্প। কিন্তু তেমন কিছু অবিষ্কার করবে না পাঠক। বিজ্ঞাপনের এ শহরে বেড়ে ওঠা লেখক শহরের প্রতিটি মানুষকে কটাক্ষ করে গড়ে তুলেছেন এ গল্পের প্লট। এ শহরের প্রতিটি মানুষকে তিনি কাক বানিয়ে দিয়েছেন। বিজ্ঞাপনের লোভে মানুষ পণ্যের পেছনে ছুটতে শুরু করে। এ স্বভাবকেই কাটাক্ষ করে হিমালয়ের ‘অমূলদ ডট ডট ডট’। সবশেষ ‘গ্রে স্কেচ’। মিলান কুন্ডেরার এক উপন্যাসের অনুবাদক হিসেবে নানান ভাবনা চিন্তা কিংবা দর্শনের কথা উঠে আসে এ গল্পে। এ গল্পে যেন উঠে এসেছে লেখকের নিজের চরিত্র। অনুবাদক হিসেবে তিনি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন মিলান কুন্ডেরার সঙ্গে। উপন্যাসের মূল লেখক মিলান কুন্ডেরা। কিন্তু পৃথিবীর এক ছোট্ট দেশে বেড়ে ওঠা লেখক তার একটি উপন্যাস অনুবাদ করলেন। এখন তার মনে প্রশ্ন জাগে, নিজ ভাষায় অনুবাদ করে পাঠককে আসল মজাটা দিবেন অনুবাদক। তবে পাঠক প্রশংসা করবে একমাত্র মিলান কুন্ডেরার। অনুবাদক এখানে তুচ্ছ। এছাড়া অনুবাদটি প্রকাশের সময় নানান প্রতিবন্ধকতার কথা গল্পে তুলে ধরেন লেখক। এভাবেই প্রতিটি গল্পে অন্যরকম সব ছাপ রাখতে পেরেছেন হিমালয়। তার গল্পে সমাজব্যবস্থা, সমস্যা উঠে আসে। যা বর্তমান সময়ের গল্পে কম দেখা যায়। বর্তমান সময়ে গল্পকারদের লেখায় ব্যক্তিসত্ত্বা বড় অংশ নিয়ে থাকে। সেখানে হিমালয় নানান স্টাইলে গল্প পরিবেশন করেন। তবে লেখকের নানান মতবাদে আপত্তি খুঁজে পাই। তিনি পাঠক নির্ধারণের কাজ করতে চান। তার বইয়ের ফ্ল্যাপে তিনি এক পর্যায়ে বলে বসেন, আপনি যদি নিছক সময় কাটানোর অভিপ্রায়ে বইটি নির্বাচন করে থাকেন, তাহলে বলবো এখানেই থেমে যান, কেননা পাঠক ধরে রাখবার মতোন যথেষ্ট আকর্ষণী ক্ষমতা আমার নেই। পাঠক কেন লেখকের বই হাতে নিবেন এটি নির্ধারণ করে দেওয়ার অধিকার লেখকের নেই। লেখক তার লেখা শেষ করা মাত্র তা সবার জন্য হয়ে যায়। অন্যের হয়ে যায়। অধিকার হারিয়ে ফেলা প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার মতো। কোন ধরনের বই কিংবা কোন গল্প পাঠককে ধরে রাখার আকর্ষণীয় ক্ষমতা রাখে সে বিষয়েও লেখক বলেন কিভাবে!!(?) এটি বলার অধিকার পাঠকের। লেখক শুধু একটি ধারণা করতে পারেন মাত্র। এর বেশি কিছু নয়। পরিশেষে বলতে হয়, লেখক মেধাবী। তার গল্পে মেধার ছাপ স্পষ্ট। ইমোশনকে তিনি খুব চমৎকারভাবে নিয়ন্ত্রণ করে নিতে পারেন। বীক্ষণ প্রান্তকে লেখক মজলিসের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এ মজলিসে পাঠক আনন্দ পাবে। ভাববে, কল্পনার জগতে প্রবেশের সুযোগ পাবে। পাঠকের জন্য এর বেশি আর কি হতে পারে!
Was this review helpful to you?
or
গল্পের রিভিউ কীভাবে লিখতে হয় আমি জানি ন। আসলে লেখালিখির ব্যাপারটা আমার কাছে অনেক কঠিন মনে হয়। তারপরও হিমেল এর খুব ইচ্ছা ওর গল্পের প্রথম রিভিউটা আমি লিখি। আসলে সহমানুষ হিসেবে ওর এই ভালবাসার ইচ্ছাটাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। সহমানুষ হিসেব ওর গল্পের প্রতি আমার ভাল লাগাটা ছিল একটু অন্য রকম। তাই ও যখন প্রতিটা গল্প লিখে, সেটা শেষ হওয়া মাত্রই আমি পড়ে ফেলতাম।। তাই বইটা প্রকাশিত হওয়ার আগেই সবগুলো গল্পের পাঠক হয়ে তা সম্পর্কে নিজের একটা মতামত তৈরি করে ফেলেছিলাম। বইটা এখন প্রকাশিত হয়ে গেছে। আমি তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, পর্যায়ক্রমে প্রতিটি গল্পেরই পৃথক রিভিউ লিখবো। আজ শুরু করছি প্রথম গল্প ‘কিন্তু’ দিয়ে ১।কিন্তু কিন্তু শব্দটা শুনলেই মনে হয় এর পর কী…। পাঠকের মনে এ রূপ আগ্রহ সৃষ্টি হয়, আর আমি যখন গল্পটা শেষ করলাম, করার পর মনে হল এর পর কী হতে পারে; মানে মনের মধ্যে কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়…গল্পটিতে দেখি লেখক পিঁপড়ার জীবনচক্র ফুটিয়ে তুলার চেষ্টা করেছে । গল্পটি পড়ার সময় মনের মধ্যে পিঁপড়াকে হিউম্যান এর সাথে কল্পনা করেছি। মানে মানুষের জীবন বাবস্থা আমার চোখের সামনে ফুটে উঠেছে। মানুষের মত, এই গল্পে পিঁপড়াদের সমাজ ব্যবস্থাপনা দেখি। সমাজে যেমন গোত্রপ্রধান থাকে, এখানেও গোত্রপ্রধান কে দেখতে পাই। এবং সেই সমাজে গ্রুপ ভিত্তিক সংগঠনও দেখি; যেখানে আবার উপ-নেতার সৃষ্টি হয়। সমাজে যেমন স্বাধীনচেতা মানুষের উপস্থিতি দেখি, তেমন এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে ষৎকো কে দেখি। আমরা মানবজাতি বেঁচে থাকি অনেক স্বপ্ন আর ইচ্ছার উপর দাঁড়িয়ে। সেখানে অনেক অসম্ভব কল্পনাও থাকে । সে উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বুকে বিরামহীন পথ চলা। কিন্তু এই পথ চলতে গিয়ে আমদের মৃত্যু ঘটতে পারে; তারপরও কল্পনা, ইচ্ছাকে আমরা জয়ই করতে চাই। সেরূপ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে ষৎকো। আবার, আরেক ক্যাটেগরির মানুষ মৃত্যুভয়ে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে, তাদের সাদাসিধে জীবন টাতে বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থাকে, আমরা আসলে কিসের জন্য এই পৃথিবীর বুকে হেঁটে চলেছি,ষৎকো কি তার জাদুর জগত টাতে পৌঁছাতে পারবে, কিংবা হতে পারবে ফড়িং?
Was this review helpful to you?
or
হিমালয় ভাই আমার বড় ভাইয়ের মত। কিংবা এক অর্থে বড় ভাই-ই। এরকম ঘনিষ্ঠ একজনের গ্রন্থ নিয়ে রিভিউ লিখতে কিছুটা হিম্মতের দরকার হয়। পছন্দের মানুষ---কাজেই রিভিউ লিখতে গিয়ে একটা বায়াস চলে আসতেই পারে। সেই বায়াস থেকে নিজেকে শত হাত দূরে রাখতে সচেতন প্রয়াসের দরকার আছে বৈকি। যাহোক, বকর বকর না করে কাজের কথায় আসি। কথা হচ্ছে উনার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ 'বীক্ষণ প্রান্ত' নিয়ে। লক্ষ করবেন, আমি এটাকে নিছক বই না বলে 'গ্রন্থ' বলছি। কারণ আছে। আমার দ্ষ্টিতে দুই মলাটে বন্দী বস্তুদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক তো বই---যেগুলো এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায় বা যায় না। আসল কথা, সেগুলো আময়া 'পড়ে ফেলি'। সেগুলো আমাদের চিতাভাবনার দরজায় টোকা দিতে সমর্থ হয় না। বছরখানেক পর আপনার কোন বন্ধু যদি জিজ্ঞেস করে, অমুক বইটা পড়েছিস, আপনি নির্ঘাৎ মাথা চুলকাবেন। দুই নম্বর ক্যটাগরীয় পড়ে 'বীক্ষণ প্রান্ত' এর মত গ্রন্থ। যার লেখার শৈলীতে ভালোমন্দ মেশানো থাকতে পারে, কিন্তু পড়তে গিয়ে তা আপনার চিন্তার দেয়ালে ঠোকর মারবেই। ভাগ্য ভালো হলে আপনার মনের দু-একটা দরজা খুলেও এতে পারে। হিমালয় ভাই'র গল্পগুলোকে এক এক করে ব্যবচ্ছেদ করার পক্ষপাতী নই আমি। গল্পগুলো উনার চিন্তাভাবনারই একটা সামগ্রিক প্রতিফলন। চিন্তাগুলোকে দার্শনিকের মত খটমটে ভাষায় রূপ না দিয়ে উনি গল্পের আশ্রয় নিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই টিপিক্যাল বাংলা ছোটগল্পের পাঠক উনার গল্প পড়তে গিয়ে সামান্য হলেও ধাক্কা খাবেন। রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা নিয়ে চিন্তাভাবনা কমবেশি সব লেখকই করেন। কিন্তু একে ছোটগল্পের পরিসরে রূপ দেবার দুঃসাহস করন খুব কমই। এই গ্রন্থে আমরা তেমনই কিছু সোশ্যাল ফিকশানের সন্ধান পাই। 'ধাঁধায় দ্বিধা' ও 'ঢ়-তত্ত্ব' তেমনই দুটি প্রতিনিধিত্বমূলক গল্প। আমার দুর্ভাগ্য, এই গল্প দুটির প্লট আমি আগেই হিমালয় ভাই'র কাছ থেকে শুনে ফেলেছিলাম। আড্ডা দেবার উদ্দেশ্যে প্রায়ই উনার অফিসে যাওয়া হত। সেই সূত্রে গল্প দুটি'র প্লট আগে থেকেই আনা ছিল। পড়তে গিয়ে দেখি, যা শুনেছিলাম, এখানেও ঠিক তাই। আমার প্রত্যাশা হয়তো একটু বেশি ছিল, তাই কিছুটা আশাহত হয়েছি। আগে থেকে প্লট জানা না থাকলে আমিও হয়তো আরো অনেকের মত-ই এ দুটো গল্প পড়ে হা হয়ে থাকতাম। এরপর থেকে কানে ধরছি, উনার কোন গল্পের প্লট আগেভগে শুনবো না। নেভার। এর মধ্যেও ঢ়-তত্ত্ব গল্পের প্লটটা আমার বিশেষ পছন্দ হয়েছে। আমার ধারণা, এই প্লট একটি চমৎকার উপন্যাস দাবি করে। গল্পের ছোট মোড়কে একে বেঁধে রাখার কোন মানে হয় না। এ আরো বেশি স্পেস ডিজার্ভ করে। আমার পছন্দের গল্প 'কর্মচারী তত্ত্ব'। সাধারণ ধাঁচে শুরু করা একটি গল্প কীভাবে শেষমেশ অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে---তার চমৎকার নিদর্শন এই গল্পটি। গল্পে গ্রেডিং এর পক্ষপাতী না আমি। তাও গ্রেড করতে বললে একে আমি পাঁচে পাঁচ দেব। বাংলা ছোটগল্পে ইলিয়াস ছাড়া আর কেউ কারো মনস্তত্ত্ব নিয়ে এতোটা ঘেটেছেন বলে আমার মনে পড়ে না। 'কিন্তু' গল্পটাও বেশ আগ্রহোদ্দীপক। প্রতিটা স্ষ্টিই প্রচলিত ফর্মের বিরুদ্ধে চলার চেষ্টা করে। এক সময় সে হয়তো ফর্মকে ভাঙতেও পারে। অতঃপর? অতঃপর সে নিজেও একটা ফর্ম দাঁড় করায় এবং অন্যদের সেই ফর্ম মেনে চলতে বাধ্য করে। এককালের প্রগতিশীল এইভাবেই পরিণত হয় একজন প্রতিক্রিয়াশীল। এরকম একটা ট্রাজেডি নিয়ে নির্মিত 'কিন্তু' গল্পের অবয়ব। তবে পাঠক হিসেবে আমি আরেকটু নতুন কিছু আশা করেছিলাম এই গল্প থেকে। সেটা পাইনি। সেটা কি পাঠক হিসেবে আমার ব্যর্থতা না লেখক হিসেবে হিমালয় ভাই'র---সে বিচারের ভার আমি অন্যদের উপর ছেড়ে দিলাম। সমাজতত্ত্ব নিয়ে আরেকটি দারুণ গল্প হতে পারতো '৩য় বন্ধনী'। আধুনিক সমাজের জন্য বিয়ে কতোটা উপযোগী ব্যবস্থা, বিয়েতে এই যে এতো আনুষ্ঠানিকতা আমরা করি---তার কোন দরকার আছে কিনা, প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিয়ে অদূর ভবিষ্যতে টিকবে কিনা---এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এই গল্পে। কিন্তু এই গল্পেও লেখক নতুন কোন বক্তব্য নিয়ে আসতে পারেননি বা তার ইঙ্গিত-ও নেই গল্পের কোথাও। হিমালয় ভাই'র বক্তব্য---এই গল্পে তিনি পাঠককে নিয়ে একটা পাজল খেলেছেন। সে পাজলটা কী বা কোথায় বা আদৌ কোন পাজল আছে কিনা---তা আমি অন্যদের কাছ থেকে শুনতে আগ্রহী। তবে যা-ই হোক, হিমালয় ভাই'র গল্প মানেই নতুন কিছু। ফর্ম ও প্যাটার্ন নিয়ে, ফিলোসফি ও সমাজতত্ত্ব নিয়ে এক ধরনের খেলা করা। যারা গল্পের শরীরে নিছক 'কাহিনী' না খুঁজে অন্য কিছুর সন্ধান করেন, তারা এই গ্রন্থ কিনলে ঠকবেন না---এইটুকু কথা দিতে পারি।
Was this review helpful to you?
or
'বীক্ষণ প্রান্ত' বইটা পড়ে দু'শ্রেণির পাঠকের মনে দুরকম উপলব্ধি ঘটবে। এক শ্রেণির পাঠকের মনে হবে, ১৪০ টাকার পুরোটাই বুঝি জলে গেল। আর বাকি আরেক শ্রেণির পাঠক ভাববে, ১৪০ টাকায় বুঝি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন! শুধু কথার কথা হিসেবে এই কথা বলছি না। বাস্তবিকই সাধারণ গল্পগ্রন্থে আমরা যে ধরণের গল্প আশা করি, তার থেকে 'বীক্ষণ প্রান্ত' সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের। সিংহভাগ পাঠকেরই গল্পগুলো পড়ে অবাক হয়ে ভাবতে হবে, এমন বিচিত্র বিষয়বস্তু, কাহিনী আর বর্ণনাশৈলির সমন্বয়ে কি গল্প লেখা সম্ভব? অথচ আপাত সেই অসম্ভব কাজটিকেই সম্ভব করার চেষ্টা করেছেন মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়। কতখানি সফল হয়েছেন এ ক্ষেত্রে, সে বিষয়ে একটু পরেই আলোকপাত করব। তার আগে বলে দেই, নিছক বিনোদনপিপাসু পাঠকের জন্য এই বইটিকে পাঠ্য হিসেবে বেছে নেয়া হবে দুঃসাহসের সামিল। তবে মনস্ক পাঠকের মনে ঝড় তুলবে এই বই নিশ্চিতভাবে। হয়তবা পাঠকের মনোজগৎ তোলপাড় করার ষড়যন্ত্র নিয়েই হিমালয় গল্পগুলো লিখেছেন! এই বই পড়া শেষে সকল পাঠকই হয়ে উঠবেন ছোটখাট দার্শনিক, সেই ভবিষ্যদ্বানি আমি এখনই করে দিচ্ছি...!!! এবার চলুন আপনাদের সাথে শেয়ার করি আমার এই বই পাঠের অভিজ্ঞতা। প্রথমেই চোখ গেল বইয়ের ভেতরের বা পাশের ফ্ল্যাপে। লেখক শুরুতেই সাবধান করে দিচ্ছেন যে এ বই পড়ে আশানুরূপ বিনোদন নাও মিলতে পারে। তাই যারা স্রেফ সুখপাঠ্য হিসেবে বইয়ের গুনাগুণ বিচার করেন, তাদের জন্য এই বই না কেনাই শ্রেয়। বুঝে গেলাম, লেখক শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে যথেষ্ট অহংকারী। অহংকারী মানুষকে আমার পছন্দ না। তাই মনে হচ্ছিল লেখকের সাবধানবাণী শুনে বইটাকে ছুড়েই ফেলি। কিন্তু পারলাম না। হাজার হোক, ১4০ টাকা দিয়ে কিনে ফেলেছি বইটা। তাছাড়া এইটা হয়ত পাঠক টানার নতুন একটা ফন্দিও হতে পারে। ১৮+ বা 'ছোটরা পড়না' জাতীয় কথা লেখা থাকলে যেমন সেই বইয়ে সবাইই একটু বেশি আকৃষ্ট হয়, তেমনি এখানে লেখক নিজেই যখন একশ্রেণীর পাঠককে বইটা কেনা থেকে বিরত থাকতে বলছেন, তখন তারাই হয়ত বেশি করে বইটা কিনবে। সুতরাং, শুরুতে এইধরনের রংঢং করে নিলে বইয়ের কাটতি বাড়বে! বৈচিত্রের দেখা মিলল উৎসর্গ পাতায়ও। লেখক তার বড়বোনকে উৎসর্গ করেছেন বইটি। তবে সাধারণভাবে নয়। নিজেদের ছেলেবেলার কিছু স্মৃতিচারণা করে, যা পড়ে পাঠকের বেশ মজা লাগবে। আবার আগ্রহও বেড়ে যাবে বইটির কনটেন্টের প্রতি অর্থাৎ গল্পগুলোর প্রতি। লেখকের যখন এত তীক্ষ্ণ রসবোধ, তখন মূল গল্পগুলোয় থাকা রসে হয়ত তারা ডুবসাঁতারও দিতে পারবে! এবার চলুন একে একে দেখি কোন গল্প কেমন লাগল আমার কাছে। ১/ কিন্তুঃ রসে ডুবসাঁতার খাব, এমন মানসিকতা নিয়ে পড়তে শুরু করে দুমিনিটেই আবিষ্কার করলাম, রস এই গল্পে যথেষ্ট আছে। কিন্তু সেই রস খুঁজে পেতে হলে পাক্কা ডুবুরি হতে হবে। তা না হলে এই লেখার গভীর থেকে রস খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে একবার যদি রসের সন্ধান পান, তাহলে বাজি ধরে বলছি সেটাকে মনিমুক্তার চেয়ে কোন অংশে কম দামি মনে হবে না! এই কাহিনী একটা পিঁপড়াকে কেন্দ্র করে। তার নাম ষৎকো। পিঁপড়াদের নাকি নিজস্ব নাম থাকে না। কেউ কেউ নিজস্ব নাম লাভের সুযোগ পায়। ষৎকোও সেই ভাগ্যবানদের একজন। কোন ক্ষমতাবলে তার এই সুযোগ মিলল, জানতে হলে পড়ুন 'কিন্তু' গল্পটা। সাথে পারবেন পিঁপড়েদের জগত আর মনোজগতেও একটা সংক্ষিপ্ত পরিভ্রমণ করতে। আর সেই ভ্রমণকালে অবাক হয়ে ভাববেন, হিউম্যান সাইকোলজির সাথে এদের এত মিল! পলিটিকাল থ্রিলারে যেমন থাকে নিয়ম ভাঙা, ক্ষমতার অপব্যবহার, ওপরওয়ালার নিষ্ঠুরতা, ওপরওয়ালার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র --- তার সব আছে এই গল্পে। আবার সামাজিক গল্পে যেমন সমাজে বড়দের সাম্রাজ্যবাদ আর ছোটদের পদদলিত হওয়ার কথা থাকে, এই গল্পে তাও আছে। আছে লিংগ বৈষম্যের উপস্থিতিও। আবার আর দশটা ধ্রুপদি সাহিত্যে যেমন চোখে পড়ে কোন এক চরিত্রের জীবনে বড় হয়ে ওঠার কামনা বাসনা, আর সেই লক্ষ্য অর্জনে নানা পারিপার্শ্বিক প্রতিবন্ধতা --- সেসবও আছে এই গল্পে। আর মজার ব্যাপার, এই এতসব দৃশ্যপট গড়ে উঠেছে ষৎকো নামের পিপড়াকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এত কঠিন কঠিন বিষয় সামান্য একটা পিঁপড়ার জীবনের ওপর ফোকাস করে ফুটিয়ে তোলার যে চেষ্টা, তা কি নিছকই ছেলেমানুষি নাকি এই গল্পেরও যোগ্যতা আছে ধ্রুপদি সাহিত্যের কাতারে নাম লেখানোর, সে বিচার তো করবে পাঠক। আর সেই বিচারে নামার আগে পড়ে ফেলতে হবে গল্পটি। কথা দিচ্ছি, নিরাশ হবেন না! রেটিং: ৮/১০ ২/ ধাঁধায় দ্বিধাঃ সবসময় আমরা বলি, সত্যিকারের বদল যদি চাই তো আগে বদলাতে হবে গোটা সিস্টেমটাকেই। আর সেজন্য পরিবর্তন দরকার সমাজব্যবস্থা, প্রশাসনব্যবস্থা আর শিক্ষাব্যবস্থার। কেমন হয় যদি কোন রাষ্ট্রের এই তিনটি উপাদানই বদলে দেয়া যায়? কেমন অবস্থা দাঁড়াবে সেই রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলার? জনগণের মধ্যেই বা কেমন প্রভাব পড়বে? সেই বৃত্তান্ত বলা হয়েছে এই গল্পে। বলতে পারেন এটা লেখকের এক স্বপ্নের দুনিয়া, যেই দুনিয়ার স্বপ্ন আমরাও দেখি কিন্তু বাস্তবতার সাথে দ্বন্দ্বে তা আর পাওয়া হয়ে ওঠে না। যাইহোক, ধাঁধারও কিন্তু একটা বড় ভূমিকা আছে উক্ত রাষ্ট্রে, যার কথা লেখক শুনিয়েছেন এই গল্পে। আর এই গল্পে এক অতি বুদ্ধিমান অথচ আইনবিরোধী ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করবে আলভেরি পানচেনি রিকারদো রদ্রিগেজ। কি অবস্থা হবে তার, ঐ রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে যাওয়ায় আর শাস্তিস্বরূপ অতি কঠিন সব ধাঁধার সমাধান করতে গিয়ে? সব জানবেন যদি পড়েন 'ধাঁধায় দ্বিধা' গল্পটি। ঘুরে আসতে পারবেন পানচেনির আশ্চর্য মনোজগতে। পরিষ্কার হয়ে যাবে এই গল্পের লেখকের অদ্ভুতুড়ে সাইকোলজিও! আপনাদেরকে আমিও একটা ধাঁধা দিচ্ছি। এই গল্প লেখার ফাঁকে ফাঁকে লেখক আপনমনে এক মজার খেলায় মেতেছিলেন। কি সেই খেলা? গল্পটি পড়ার সময় একটু নজর রাখবেন সবদিকে। তাহলেই উত্তর মিলবে আমার এই ধাঁধার! রেটিং: ৭.৫/১০ ৩/ ৩য় বন্ধনীঃ ধর্মীয় কুসংস্কার আর সমাজব্যবস্থার পশ্চাৎপদতা যদি হয় আধুনিক পৃথিবী গঠনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার প্রধান দুই বাঁধন অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় বন্ধনী, তাহলে ব্যক্তিত্বের সংঘাত হয়ত এক্ষেত্রে তৃতীয় বন্ধনী। খুব সম্ভবত এটাই এই গল্পের মূল বক্তব্য। এই বইয়ের আগের দুইটা গল্পে ইশারা ইঙ্গিতে যে কথাগুলো বলা হয়েছে, এই গল্পে তা একটু বিস্তৃতভাবে ফুটে উঠেছে। কাহিনী গড়ে উঠেছে শরিফুল চরিত্রকে ঘিরে যে চায় কোন রকম সামাজিক আড়ম্বর এবং ধর্মীয় আচার ব্যতিরেকে ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে। মজার ব্যাপার, এর প্রধান কারণ শেষ বয়সে এসে নতুন আঙ্গিকে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ। সেটা কিভাবে, গল্প পড়লেই বুঝবেন। তবে একটা কথা বলে রাখি, আগের দুই গল্পে লেখকের পরিমিতবোধের পরিচয় পাওয়া গেলেও এই গল্পে তা অনুপস্থিত। কিন্তু লেখক যে বার্তাটি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন, সেটা পাঠক হিসেবে আমার চোখে ধরা পড়েছে বেশ মোটা অক্ষরেই। এই গল্পের আরেকটি আকর্ষনীয় দিক গল্পের বাঁকে বাঁকে লেখক যেভাবে এক কাল্পনিক পাঠক/সমালোচকের কাল্পনিক সমালোচনাধর্মী বক্তব্যের সন্নিবেশন ঘটিয়েছেন এবং যেভাবে হাস্যরসাত্মকভাবে সেসব বক্তব্যের যোগ্য প্রত্যুত্তর দিয়েছেন। পুনশ্চঃ একটা একটা করে গল্প পড়ছি আর সে সম্পর্কে লিখছি। তবে প্রায়োগিক দিক দিয়ে আগের দুটি গল্পের চেয়ে এইটা কিছুটা কমজোরি লেগেছে। অথচ বিষয়বস্তু বিবেচনায় এটা হতে পারে আগেরগুলোর চেয়ে বেশি বিতর্কিত ও শক্তিশালী। আরেকটা বিষয়, এই গল্পে আমি অনেকগুলো বানান ভুল খুঁজে পেয়েছি!!! রেটিং: ৬.৫/১০ ৪/ অমূলদ ডট ডট ডটঃ যারা রহস্য ভালবাসেন, তারা খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও হারিয়ে যাবেন একটা অদ্ভুত রহস্যের মায়াজালে। 'so, what is behind the crow?' কি অর্থ হতে পারে এর? কাকের পেছনে কি আছে, সেটা কি জানা খুব জরুরি? নাকি এটা কোন সিক্রেট কোড? তাহলে কেন এই কথাটা দেশের অনেকের মোবাইলে মেসেজ আর মেইল হিসেবে পাঠানো হচ্ছে? কিছুদিনের মধ্যেই কেন শহরের বিলবোর্ড, দেয়ালসহ সর্বত্র একটা কাকের ছবি আর কিছু অর্থহীন কথায় ছেয়ে গেছে? এই রহস্যের জট খুলবে 'মূলদ অমূলদ ডট ডট ডট' গল্পে। প্রথম তিনটি গল্প পড়ে আসার পর এমন একটা গল্প অনেকেরই ভাল লাগবে না। অন্তত ছেলেমানুষি বিষয়বস্তুর কারণে। অবশ্য এখানেও লেখকের একটা সুস্পষ্ট মেসেজ আছে। তিনি একটা জিনিস ধরতে চেয়েছেন যে ইন্টারপ্রিটেশনের ক্ষেত্রে একটা ছবির ভূমিকা কতটুকু। আবার অস্বাভাবিক বা বিতর্কিত কোনকিছু মানবমনে কতখানি প্রভাব ফেলে, সেটাও বেশ ভালভাবেই ফুটে উঠেছে গল্পে। কিন্তু সবকিছুই বেশ খাপছাড়া লেগেছে। তারপরও একটা কথা বলতে পারি, এই গল্পের অভিনবত্বেও বারবার মুগ্ধ হবেন পাঠক, অন্তত তারা যারা এই প্রথম পড়ছেন হিমালয়ের লেখা! রেটিং: ৫.৫/১০ ৫/ গ্রে স্কেচঃ কে জানে, হয়ত হিমালয়ের নিজের জীবনের অসুখকর স্মৃতি ও মানসিক অবস্থার চিত্রই এই গল্পে স্থান পেয়েছে। আপনারা জানেন এই গল্পের লেখক একজন অনুবাদকও। হয়ত অনুবাদক হিসেবে জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার তাড়নায় লিখেছেন এই গল্প। কিংবা এটা স্রেফ তার কল্পনাশ্রিত আরেকটি গল্পও হতে পারে। এখানে লেখক বলেছেন এক ব্যক্তির কথা যাকে কুন্ডেরার একটি উপন্যাসের বাংলায়ন করতে গিয়ে জীবনে অনেক কিছুই স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, বারবার সে জড়িয়ে পড়েছে কুন্ডেরার সাথে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বে। আসলেই তো, একজন অনুবাদক কত কষ্ট করে, কত সময় ও মেধার অপচয়ে একটা অনুবাদ করেন, অথচ সেটা প্রকাশ হলে মানুষ ধন্যি ধন্যি করে মূল লেখকের। কিন্তু তাই বলে কি অনুবাদকের কৃতিত্ব কোন অংশে কম? ............ যাইহোক, এত জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় নাই বা গেলাম। আমাদের এই গল্পের চরিত্রটির কুন্ডেরার উপন্যাস অনুবাদ করতে গিয়ে কি পরিণতি হয়, জানতে হলে পড়ুন এই গল্পটি। আর আপনি যদি একজন উঠতি লেখক হন, তাহলে তীব্রভাবে আপনার মনোজগতে নাড়া দেবে এই লেখা। মনে হবে, হিমালয়কে জড়িয়েই ধরেন বাস্তব সত্যগুলোকে এত সুন্দরভাবে প্রতীয়মান করে তোলার জন্য! রেটিং: ৭.৫/১০ ৬/ বরফবিম্বঃ বাস্তবতাকে কল্পনার মোড়ক পরিয়ে নতুনত্বের আবেশ ছুঁইয়ে দেওয়া এক গল্প। পাঠককে কিছুটা হেনস্তা করারও মতলব খুঁজে পেয়েছি গল্প শুরুর পূর্বে কিছু হাস্যকর মাত্রাবিষয়ক মতবাদ দেয়ায় এবং গোটা গল্প সেই মাত্রাত্রয়ের সমান্তরালে এগিয়ে নেওয়ায়। কিন্তু সেসব কথা ছাড়ি, প্রকাশভঙ্গিমায় এই গল্প আগের পাঁচটি গল্পকেই হার মানিয়েছে। আরও বলতে হয় এর অসাধারণ বিষয়বস্তু। সৃষ্টিতত্ত্ব, প্রকৃতিতে আত্মা ও দেহের অস্তিত্ত্বের রহস্য, কালের বিবর্তনে ভৌগলিক পরিবর্তন, প্রকৃতির ধ্বংসলীলা, এক জেনারেশনের তফাতেই একটি বংশের বিনাশলাভ --- প্রতিটি নিয়েই কখনো না কখনো কোন বাঙালি লেখক লিখেছেন। কিন্তু বড়জোর সেগুলো আত্মকথা বা প্রবন্ধে বা পত্রিকার কলামে স্থান পেয়েছে। কোন একটি উপাদান নিয়ে কেউ কেউ গল্প/উপন্যাসও লিখেছেন। কিন্তু সবগুলোকে একসাথে নিয়ে, তার সাথে নাটকীয়তার মিশেলে গল্পের আবহ সৃষ্টি, এটাই হিমালয়ের নতুনত্বের সাক্ষী। সাথে আছে কোন এক খেলনা খোঁজা নিয়ে মনস্তাত্বিক খেলাও। মানুষ কি পায় সেই খেলনার খোঁজ, নাকি ব্যর্থ মানুষ একসময় ভুলে যায় খেলনার কথা? সেটা জানতে হলে 'বরফবিম্ব' পড়তেই হবে! মৃত্যু নিয়ে মানবিক আবেগ, জনৈক আত্মার অতিমাত্রায় খাপছাড়া অবৈজ্ঞানিক (!) কথাবার্তা কিংবা কোন এক দেশান্তরীর সূক্ষ্ম দেশপ্রেম, তুলির আঁচড়ে যেন সকল ক্যানভাসেই একটু করে হলেই রঙ চড়িয়েছেন লেখক। আর তাই আর বিনা বাক্যব্যয়ে, এই বইয়ের আগের পাঁচটি গল্পের সাপেক্ষে এই গল্পের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করছি! রেটিং: ৯/১০ ৭/ কর্মচারী যজ্ঞঃ মহত্ত্ব সর্বদাই পরম পূজনীয়। কারো কারো কাছে তা পরম আরাধ্যও বটে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন মহৎ মানুষের তকমা গায়ে এঁটে থাকা ব্যক্তির কাধ থেকে ক্রমেই যদি মহত্মের জোলা নেমে যেতে থাকে, তাহলে তার মানসিক পরিণতি কেমন হয়, আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি? মহৎ মানুষ অপরের মহত্মকেও সম্মানের চোখে দেখবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজীবন মহৎ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মানুষটার কি বিবেকবোধ লোপ পেতে পারে না? সে কি তার মহত্বকে ধরে রাখতে কখনো কখনো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে না? এমনই এক কাহিনী নিয়ে এই গল্প। আরেকটি সাইকোলজিকাল মাস্টারপিস। অবশ্য এইধরনের গল্প আগেও পড়েছি। আবার এই গল্পে গল্প বলার ধরণটাও অনেকের কাছে নতুন নতুন ঠেকতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব লেখকই কখনো না কখনো এমন গঠনরীতি অনুসরন করেছেন। তাই এটা হিমালয়ের নিজের উদ্ভাবিত কোন ক্ষেত্র নয়। তারপরও এই বইতে অন্যান্য গল্প যেমন কঠিন ভঙ্গিমায় লেখা হয়েছে, তার থেকে এটা কিছুটা সহজ ধাঁচের। তাই আগের গল্পগুলো যাদের কাছে ভাল লাগেনি, তাদের কাছেও এটাকে সুখপাঠ্য বলে মনে হবে। রেটিং: ৮.৫/১০ ৮/ গল্প গবেষণা প্রকল্পঃ এই প্রকল্পের গিনিপিগ হলাম আমরা পাঠকরা। লেখক তার মস্তিষ্কপ্রসূত এই প্রকল্পটি আমাদের দিয়ে টেস্ট করিয়ে নিয়ে চেয়েছেন। ব্যাপারটা অভিনব হলেও আগ্রহ উদ্দীপক নয়। তার কারণ, গাণিতিক সূত্রের অধীনে সাহিত্যকে ফেলা আদৌ কি যৌক্তিক? অনেক বেরসিক বলবেন, 'এইসব ছাড় হিমালয়! সাহিত্যকে সংখ্যার মায়াজালে বেঁধো না।' আমারও কেন জানি না একই জিনিস মনে হয়েছে। বইয়ের এই অংশটা কারো কাছে ভাল লাগবে, কেউ মজা পাবেন, কেউ হবেন অবাক। তবে এইটা গ্যারান্টি দিতে পারি যে অধিকাংশই হবেন লেখকের প্রতি বিরক্ত। যেমনটা হয়েছি আমি। তবে লেখক কিভাবে সাহিত্যকে সংখ্যার মাধ্যমে চালনা করতে চেয়েছেন, সে বিষয়ে কৌতূহল মেটাতে পড়তেই পারেন 'গল্প গবেষণা প্রকল্প' শীর্ষক লেখাটি। পুনশ্চঃ মাইক্রোসফট অফিস ওয়ার্ডে 'ওয়ার্ড কাউন্ট' আর 'ক্যারেক্টার কাউন্ট' নামে দুটো অপশন আছে বলেই এই ছেলেমানুষিকে চরিতার্থ করতে পেরেছ, হিমালয়। হাতে কর গুণে গুণে যদি এই ধরণের লেখা লিখতে হত, তাহলে কি পারতে? রেটিং: ৬/১০ ৯/ গ্যাফফ্লাইঃ এই গল্পটি আমাকে খুব বেশি টানতে পারেনি। তার কারণ, লেখক শব্দচয়নে বেশ কুশলী হলেও ঘটনার যথাযথ বর্ণনায় তার বেশ দুর্বলতা রয়ে গেছে। গল্পে কি ঘটছে, সেটাই যদি বুঝতে আমাকে বেগ পোহাতে হয় তাহলে গল্পে মনোনিবেশ করব কিভাবে? সক্রেটিসের গ্যাডফ্লাই তত্ত্বকে পুঁজি করে গল্পটা রচনা করা হলেও আঙ্গিক দুর্বলতায় তার ধারেকাছেও যেতে পারেননি। তবে একটা কথা বলতেই হবে, গল্পের অন্যতম প্রধান বাহন চরিত্রদের মধ্যকার কথোপকথন হলেও এই বইতে তার দেখা খুব বেশি মেলেনি। তবে 'গ্যাডফ্লাই' গল্পে এসে অবশেষে তার দেখা পেলাম। তারপরও বলতে হয়, লেখক কাশেম চরিত্রের কথাবার্তায় বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন ভালো কথা। কিন্তু হাজার হোক, তা তো লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ। তাই এগুলোকে অতিমাত্রায় মহিমান্বিত করার চেষ্টা বোধ হয় না করলেও চলত। সংলাপগুলো বেশ ওজনদার, তাই এমনিতেই পাঠকের নজর কাড়ত। আলাদা করে সেগুলোকে হাইলাইট করতে যাওয়ার কি খুব দরকার ছিল? রেটিং: ৭/১০ ১০/ ঢ়-তত্ত্বঃ এই গল্পের জন্য আলাদা কোন রিভিউ লেখা দরকার বলে মনে করি না। গল্পের নামকরণ নিয়ে লেখকের ব্যক্তিগত বক্তব্য গল্পের শেষে পড়ে নেবেন, তাহলেই আর গল্পটির এই নাম রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে আপনাকে মাথা কুটে মরতে হবে না। যাইহোক, কথায় আছে শেষ ভাল যার সব ভাল তার। একদম তাই। গল্পের প্লট অসাধারণ সুন্দর। রুপকথা বলে কেউ যেন একে ভুল না করেন। সুদূর ভবিষ্যতে হয়ত এমনটাই দাঁড়াবে বাস্তবতা। লেখকের পরিমিতভোধ, শব্দচয়নে কুশলতা আর অপূর্ব বর্ণনাভঙ্গিতে এই গল্প পেয়েছে আলাদা মাত্রা। শুধু তাই নয়। এই গল্পটার উপস্থিটিতে গোতা 'বীক্ষণ প্রান্ত' বইটিই হয়ত উঠে গেছে এক স্তর উপরে। এর বেশি কিছু বলতে চাই না। নিজেরাই গল্পটি পড়ে দেখুন কি যাদু আছে এতে! রেটিং: ১০/১০ শেষ কথাঃ সবমিলিয়ে বইটা কেমন, তা অনুধাবন করতে হলে যাচাই করে নিন বইটি ১০০ তে কত পেল। প্রতিটি গল্পের আমি আলাদা আলাদা রেটিং দিয়েছি। সেগুলো যোগ করলে যোগফল দাঁড়ায় ১০০ তে ৭৫.৫। অর্থাৎ আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার গ্রেডিং ধরলে এটি পেয়েছে 'এ'। অল্পের জন্য হয়ত এ+ মিস করল কিন্তু তাতে কি? মনটা কিন্তু ঠিকই জয় করে নিয়েছে আমার। এবং আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি, এই বই পড়ে আপনারাও আমার মত সমান আনন্দলাভ করতে পারবেন। এই লেখার শুরুতে প্রশ্ন তুলেছিলাম, ''এমন বিচিত্র বিষয়বস্তু, কাহিনী আর বর্ণনাশৈলির সমন্বয়ে কি গল্প লেখা সম্ভব?'' এখন বলতে বাধ্য হচ্ছি, হ্যাঁ। অবশ্যই সম্ভব। হিমালয় এই অসম্ভবকে শুধু সম্ভবই করেন নি, আমার মতে এ গ্রেড পেয়ে পাস করেছেন। আপনাদের কারো কারো বিচারে হয়ত 'এ+' ও পেয়ে যাবেন। পরিশেষে একটা কথাই বলব। আমার এই ধরণের রিভিউ আর প্রতিটি গল্পের রেটিং প্রণয়নে লেখকের লেখকসত্ত্বা হয়ত আঘাত পাবে কারণ তার নিজের বিচারে হয়ত প্রতিটি গল্পই ১০/১০ পাওয়ার যোগ্য। তাই এখানে একটা কথা ক্লিয়ার করে দেই, এটা কেবলই আমার ব্যক্তিগত অভিমত। একে সিরিয়াসলি নেবার কোন দরকার নাই।
Was this review helpful to you?
or
এই লেখাটি প্রচলিত অর্থে রিভিউ নয়। আমি চেষ্টা করেছি লেখক মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়ের কিছু সাহিত্যিক কৌশলকে বোঝার। লেখাটি শুরু করার আগে আমি লেখকের গল্পগুলোর (পূর্বের “প্রযত্নে হন্তা” এবং বর্তমানের “বীক্ষণ প্রান্ত” সম্পর্কে প্রযোজ্য) একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে দুটো কথা বলতে চাই। অবশ্যই এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ। লেখকের অধিকাংশ গল্পের মূল ন্যারেটিভটা বিভিন্ন ডিটেইল এবং পারিপার্শ্বিক স্কেচের আড়ালে ডুবে থাকে। একজন শিল্পী (আমার মতে) একজন পারদর্শী “হাইড এন্ড সিক” খেলুড়ে হওয়া জরুরী। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে অন্তিম সিদ্ধান্তের চেয়ে ঐ বিষয় নিয়ে চিন্তার চলমান প্রক্রিয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই স্বতঃসিদ্ধে আমরা এজন্যই পৌঁছাতে পারি কারণ, আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, বৌদ্ধিক অধিকাংশ বিষয়ই, যাকে ইংরেজিতে বলে, “ওপেন এন্ডেড”। অর্থাৎ নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য কোনো সর্বসম্মত তাত্ত্বিক উপায়ের কথা আমাদের জানা থাকে না। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝানো সহজ হবে। রাস্তা-ঘাটে প্রেমিকার সাথে কিঞ্চিৎ শরীরবৃত্তীয় আচরণ করা আমাদের প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ব্যবহারের সাথে খাপ খায় না। যদি কেন খায় না, সে প্রসঙ্গে প্রশ্ন করি তাহলে বিভিন্ন মত আসবে। অধিকাংশই নৈর্ব্যক্তিক নয়। ব্যক্তিগত স্পেসে পক্ষে যুক্তি আসলে তাকে প্রতিরোধ করা যায়। রাস্তায় শৌচকর্মকে আমরা সমাজ-সংস্কৃতি রসাতলে যাবার প্রধান কারণ মনে করি না, খুব বেশি হলে লঘু অভদ্রতা মনে করি। উপরের প্যারায় উল্লেখিত স্বীকার্য যদি সত্যি বলে মেনে নিই তাহলে আমরা একমত হতে পারবো, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের চেয়ে চিন্তন প্রক্রিয়া বেশি গুরুত্বের দাবি রাখে। সুতরাং “হাইড এন্ড সিক” ঠিকমতো খেলতে না পারলে গল্প একরৈখিক হয়ে পড়ে। এবং বিচিত্র চিন্তন উৎপাদনের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এই জায়গাটিতেই হিমালয়কে আমি এগিয়ে রাখবো। তার বিভিন্ন গল্পে আলোচিত প্রেক্ষাপট, পর্যবেক্ষণ থেকে বিভিন্ন অনুসিদ্ধান্ত, কার্যকারণের ধারাবাহিকতা ইত্যাদি নিয়ে দিনভর তর্ক হতে পারে। একমত না হলে গোটাকয়েক গালিও দিয়ে ফেলতে পারি। কিন্তু হিমালয় সচেতনভাবে তার গল্পগুলোতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়া থেকে বিরত থাকে। তাই গল্প কখনোই ঈশপ/প্যাম্ফলেট/ সমাজ বিজ্ঞানের অভিসন্দর্ভ হয়ে উঠেনি। আশা করি তার গল্পের সাহিত্যিক কৌশল আলোচনার আগে, একটি ক্ষেত্র আমি প্রস্তুত করতে পেরেছি। এখন তুলনামূলকভাবে কম ‘সার্বিক’ কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক। Deconstruction বা বিনির্মাণ: হিমালয় তার বেশ কিছু লেখায় (‘কিন্তু’, ‘ধাঁধাঁয় দ্বিধা’, ‘৩য় বন্ধনী’, ‘ঢ়-তত্ত্ব’ এবং প্রযত্নে হন্তার ‘41’) একটি স্ট্রাকচার এর কথা বলে। সেই স্ট্রাকচারগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই “অলটারনেটিভ স্ট্রাকচার”, অর্থাৎ সেগুলো আমাদের চেনা/পরিচিত কোনো প্রতিষ্ঠান/সামাজিক ব্যবস্থা নয়। লেখকের স্ট্রাকচার বিশ্বাসযোগ্য এবং নিশ্ছিদ্র করার প্রচেষ্টাটি বেশ চমকপ্রদ। তার ডিটেইলের ব্যবহার পরিমিত কিন্তু সম্পূর্ণ। যার ফলে স্ট্রাকচারটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটে উঠে। অলটারনেটিভ স্ট্রাকচার নিয়ে কাজ করার প্রধান ‘খেলা’ টা কিন্তু এই ডিটেইলগুলিই। অলটারনেটিভ স্ট্রাকচার দিয়ে , The writer does not want to sell you the structure itself, which he knows to be non-existent, what he tries to do is to put some specific correlation with the thoughts which we do know and experienced, to the mental phenomenon which arises in that ‘alternative settings’. এই কৌশলের একটি বিপদ হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই পাঠক এই অলটারনেটিভ স্ট্রাকচারটিকেই গল্পের কনটেন্ট ভেবে ভুল করে। সাবধান হলেই বরং গল্পের বক্তব্যের সমতলে চিন্তা করা যায়। অলটারনেটিভ স্ট্রাকচারের ভাল উদাহরণ জর্জ অরওয়েলের “1984”; প্রথাগত রূপক সাহিত্যে কোরিলেশন বা অন্তমিলগুলো সাধারণত one to one correspondence মেনে চলে। সেই ক্ষেত্রে লেখকের চাতুরি দেখানোর ক্ষেত্র তুলনামূলকভাবে সীমিত। অরওয়েল এরই “এনিমেল ফার্ম” এরকম ‘ওয়ান টু ওয়ান করেসপনডেন্স’ মেনে চলে। হিমালয় সম্ভবত সচেতনভাবেই এই প্রথাগত রূপকের পথে হাঁটেনি। তার কৌশল তুলনামূলক জটিল। আমার পর্যবেক্ষণে তার মূল কৌশলটি ছিল ননলিনিয়ার কোরিলেশন। যার ফলে সে একধরনের ডিকনস্ট্রাকশনের মধ্য দিয়ে গল্পের প্রেক্ষাপটকে প্রবাহিত করেছে। এই ডিকনস্ট্রাকশন কিন্তু ‘ডিসট্রাকশন’ নয় কোনোভাবেই। স্ট্রাকচারের ধ্বংসের জন্য প্রয়োজন উদ্দেশ্যহীন শক্তি। উদ্দেশ্যহীন শক্তির চমক থাকতে পারে, বৈচিত্র্য নেই। ধ্বংসের প্রক্রিয়া তাই তুলনামূলকভাবে সহজ। খুব সহজেই আমরা বিপ্লব করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারি, কিন্তু একনায়কের প্রতি থুতু নিক্ষেপণের কাজে তুচ্ছতম অগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটিকেই বাধা দিতে পারি না। বিনির্মাণ সেক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অনেক জটিল, একাধিক পর্যায়ে বিন্যস্ত এবং অনেক ক্ষেত্রেই স্ববিরোধী। হিমালয়ের গল্পের চরিত্র/ প্রেক্ষাপট – তাই সচেতনভাবেই বিনির্মাণে ব্যস্ত। তারা ব্যাপক এবং শক্তিশালী। তবে তাদের শক্তির প্রয়োগ উদ্দেশ্যহীন নয়। হিমালয়ের সাবধানী ডিটেইলের ব্যবহার, এই বিনির্মাণ প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করে অসাধারণভাবে। বিনির্মাণের কিছু উদাহরণ দেয়া যায়- (১) ‘কিন্তু’ গল্পের চিন্তাশীল ‘পিঁপড়া’ হঠাৎই ‘self awareness’ এ আক্রান্ত হয়। যথারীতি- যে কোনো নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন বুদ্ধিমত্তার কারণে, সে প্রশ্ন করা শুরু করে জীবনের অর্থের পরিধি ও ব্যাপকতা নিয়ে। sense of nothingness তাকে তার জীবনের পরিপার্শ্ব সম্পর্কে skeptic করে তোলে। গল্পের স্ট্রাকচারটিকে পরিবর্তনের যে চেষ্টা এইখানে পিঁপড়েটি হাতে নেয় তা সত্যিকার অর্থে পিঁপড়ের সমাজ নয়। বরং একটি self aware বুদ্ধিমত্তার দার্শনিক সংকটকে পুনর্সংজ্ঞায়নের প্রচেষ্টা হিসেবেই দেখা উচিত। অবশ্য পিঁপড়ের অভিজ্ঞতা একটি মর্মান্তিক পুনরাবৃত্তির গড্ডায় পড়ে যায়। সত্যিকার অর্থে “অর্থময়তা” অলক্ষ্যেই থেকে যায়। আকাঙ্ক্ষেয় “অর্থ” আসলে পুরনো অর্থহীনতাকে নতুন অর্থহীনতা দ্বারা প্রতিস্থাপন করে। ক্রমবর্ধমান অর্জিত জ্ঞান/ অভিজ্ঞতা কেবল “অর্থহীনতা”র নতুন সংজ্ঞায়নে সক্ষম। তাই আত্মসচেতন বুদ্ধিমত্তা কেবল তার আত্মসচেতনতার অভিশাপ ‘sense of nothingness’ এর পরিধিই বাড়াতে সক্ষম। ক্রমাগত দার্শনিক বিনির্মাণ ছিল এই গল্পের আরবী ঘোড়া। (২) ধাঁধাঁয় দ্বিধা গল্পের শুরুতেই মহাকাব্যিক বিস্তৃতির একটি ইউটোপিয়ান স্ট্রাকচার ফুটে ওঠে। সেই স্ট্রাকচার সকল দিক থেকে “সঠিক মানুষ” তৈরির কারখানাকে ব্যাখ্যা করে। কিন্তু গল্পের আকর্ষণ স্ট্রাকচারের দুর্বলতা নিয়ে নয়; স্ট্রাকচারকে ঠিক অস্বীকারও গল্পে করা হয়নি। কোনো অসংগতিও চোখে পড়েনি। গল্পে দেখা যায়, কীভাবে একজন ‘সঠিক’ মানুষ নিজের জন্যে যে ফর্মুলা নাজিল হয়েছে, তার অর্থ উল্টে দিতে চাচ্ছে। তার বিনির্মাণ ঠিক স্ট্রাকচারবিরোধী নয়। স্ট্রাকচারের এনিহিলেশনও তার কাম্য নয়। তবে ডিকনস্ট্রাকশনেই তার আগ্রহ। শাস্তিই তার কাছে পুরস্কার। Process of increasing radius: হিমালয়ের সবচেয়ে মুন্সিয়ানা আমার মতে এই কৌশলটিতে। তার বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের গল্পে এই কৌশলের সফল প্রয়োগ ঘটেছে। Process of increasing radius বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি তা ব্যাখ্যার দাবি রাখে। গল্পের scope সাধারণত একটি সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র হয়। এই ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলকে আমরা ব্যাসার্ধ দ্বারা Categorize করতে পারি। প্রথমেই আলোচনা প্রয়োজন গল্পের ক্ষেত্রফলকে ঘিরে। এই ক্ষেত্রফল সূচিত করবে গল্পের মাঝে বর্ণনাকৃত স্থানকাল, পাত্রপাত্রীর সংখ্যা, মনোজগতের উপাদানসমূহের সমষ্টি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও তাদের আন্তঃসম্পর্ক, প্রতিবেশ ও তার সাথে গল্পের মিথষ্ক্রিয়া। এই ক্ষেত্রফল শুধু বস্তুগত বিষয়াদি, অবস্তুগত দার্শনিক উপাদান ছাড়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিভিন্ন উপাদানের পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া। কারণ গল্প শুধু অসংখ্য বিশেষ্যের সমষ্টি নয়, অসংখ্য ক্রিয়াপদেরও সমষ্টি। এই বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদের সামষ্টিক অর্থনীতিকেই আমরা গল্পের scope বলতে পারি। গল্পে যেহেতু প্রবাহমান গতি রয়েছে, তাই গল্পে এ প্রবাহমানতার সাথে, scope এরও বৃদ্ধি/হ্রাস ঘটতে পারে। গল্পের scope হ্রাসের পেছনে তাত্ত্বিক কোনো বাধা না থাকলেও সাধারণত গল্পে scope এর হ্রাস ঘটে না। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের মত scope সাধারণত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে The process in which the effective radius of the scope increases is not intentionally controlled by the writer. This process of increasing scope is not usually used by the writer as a major tool. The process happens because of a by-product of the actual plot development. আলবেয়ার কাম্যুর ‘প্লেগ’ অবশ্য একটি অসাধারণ উদাহরণ,যেখানে কাম্যু সচেতনভাবেই এই টেকনিকটি ব্যবহার করেছিলেন plot develop করতে। That’s why there were details given about the whole town is inferred very precisely. হিমালয়ের বেশ কয়েকটি গল্পে এই কৌশলটি ব্যবহৃত হয়েছে। তার গল্পের স্কোপ সাধারণত ছোট গল্পের প্রথাগত স্কোপ এর চেয়ে বড় হয়, এবং সেই স্কোপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। চিন্তন প্রক্রিয়া,এনার্কী ইত্যাদি চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভাইরাস কিংবা বোমার মাশরুম ক্লাউডের মতোই একটি বস্তুগত/অবস্তুগত অনুষঙ্গ ভীতিকর গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। হিমালয়ের মুন্সিয়ানা, কীভাবে এই Process of increasing radius বাড়তে থাকে, তার আকর্ষণীয় বর্ণনাতে। তার পরিমিতিবোধের সফল প্রয়োগের ফলে প্রায় প্রতিটি বাক্যেই গল্পের স্কোপ বাড়তে থাকে। এই উদাহরণ আমরা পাই তার বেশ কিছু গল্পে (‘কিন্তু’, ‘ধাঁধাঁয় দ্বিধা’, ‘ঢ়-তত্ত্ব’, ‘অমূলদ ডট ডট ডট’ ইত্যাদিতে) পরিশেষ: সার্বিকভাবে হিমালয়ের গল্পগুলো অভিনব। তারা ভাল/খারাপ কিনা এই বিতর্ক অর্থহীন। কারণ ভাল/খারাপ অত্যন্ত subjective বিষয়। কিন্তু অভিনবত্বকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি। আমাদের চর্চিত জ্ঞান/অভিজ্ঞতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুনরাবৃত্তীয়। ‘অভিনবত্ব’ তাই সৃজনশীলতার একটি সৎ-মাপকাঠি হতে পারে। কারণ পুনরাবৃত্তীয় প্রতিবেশে অভিনবত্বের মাধ্যমেই সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ প্রকাশ হতে পারে। লেখকের প্লট, চরিত্র,স্কোপ সবকিছুই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিনব এবং সরল পর্যবেক্ষণজাত নয়। যা কিছু পর্যবেক্ষণ করা হয় তার faithful reproduction এলে পুনরাবৃত্তির দোষে দুষ্ট হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। লেখক সচেতনভাবেই এই প্রক্রিয়া থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকেন। গল্পের উদ্দেশ্য শিক্ষামূলক নয়/ সমাজ সংস্কারমূলক নয়। গল্পের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে তার নির্মোহ থাকার প্রবণতাই আমাদের অসাধারণ কিছু অভিনব গল্প উপহার দিয়েছে।
Was this review helpful to you?
or
আমি খুব সহজ পাঠক না । তবে আমি মোটামুটি পড়ি । আমি যে ধরনের বই পড়ি । তা এই বইয়ের সাথে যায় না । যদি জীবনের প্রথম বই এটা হতো আমি কোন দিন মনে হয় বই পড়তাম না । খুব কঠিন ধরনের বই । তবে লেখকের লেখনি শক্তি অনেক বেশি । তার চিন্তা শক্তি যে কত বড় তা কিন্তু বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠাতেই লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন । লেখক পরিচিতি এমন হতে পারে আমি কোন দিন কল্পনা করতে পারিনি । আজব । মানুষ । এক কথায় বলা যায় । দেশে নতুন ধারার লেখক আসছে । বাংলাদেশ যে উন্নত হচ্ছে । ডিফরেন্ট চিন্তা করতে পারে তা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে । আমার এই ছোট মাথায় তাই বলছে । এই লেখকের অন্য কোন কাজ না করে সারাদিন বই লেখা উচিত বলে আমি মনি করি । শব্দ লিখতে হবে ২৫০ খুব কম হয়ে গেছে । আরো বেশি দিলে ভালো হতো । লেখালেখি জগতে নতুন এই উদিয়মান লেখককের সব বই আমি পড়বো আশা রাখছি । সামনে । তার জন্য শুভ কামনা রইলো । উল্লেখ থাকে যে তার লেখা প্রথম বইটি আমি লেখকের হাত থেকে নিতে পেরেছিলাম ।
Was this review helpful to you?
or
"বীক্ষণ প্রান্ত" এর প্রতিই গল্পই আপন স্বকীয়তা ও স্বতন্ত্রে মস্তিষ্ক পটে নতুন চিন্তার ,নতুন চেতনার উম্মেষ ঘটায় ।গল্পগুলোর সম্মোহনী লেখনী কৌশল বাংলা সাহিত্য জগতের এক নতুন দ্বার উম্মোচন করেছে । বই নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে বিবেচ্য হয় সেটা বোধ হয় বইটির অন্তর্গত সাহিত্যরসের বিতরণ ।কিন্তু একটু সচেতন পাঠকেরা শুধু এটির মধ্যে আটকে থাকতে বাধ্য নন ,তারা খোঁজেন উন্নত উপস্থাপন সমৃদ্ধ গল্প , বিস্তৃত করতে চান তাদের চিন্তার জগত । এদিক থেকে ''বীক্ষণ প্রান্ত'' বইটি এ দুই শ্রেণির পাঠককেই নিরাশ করবে না । এছাড়া , এই বইয়ের গল্পগুলো তো বাস্তবকে অতিক্রম করেছে , সম্ভবনাকে রূপান্তরিত করেছে চিন্তায় । এবার একটু গল্পের বিস্তৃতির কথনে আসা যাক । বইয়ের আদিতে যে গল্পটি দৃষ্টিসম্মুখে আসে তা হল "কিন্তু" । এ শব্দটির মাঝেই কেমন যেন অনিশ্চয়তার বিচরণ । তাই গল্পের উত্তরকালেও পিপড়ের জীবনের সেই অনিশ্চয়তার দেখা মেলে । তবে এখানে লেখক পিপড়ের মাধ্যমেই মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিকের প্রকাশে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন । তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাঠকরা গল্পের অগ্রসরতার দিক অনিশ্চয়তায় পড়তে পারেন । পাঠকের কাছে এ ধরনের স্বতন্ত্রতা অবশ্যই মুগ্ধতার দাবি রাখে । সব মিলিয়ে আত্ম অস্তিত্বের পরিধি ও তার ব্যবপকতার আদলে এক অনবদ্য গল্প রূপায়িত হয়েছে । পরের গল্পটির নাম "ধাঁধায় দ্বিধা" । এ গল্পটির শুরুটাতে লেখকের এক ভিন্ন মহাকাব্যিক বিস্তৃতির আড়ম্বর দৃষ্টি এড়ায় না ।আর একটা সত্যি কথা বলতে কি,এই গল্পটি পড়ার এক পর্যায়ে গল্পের চরিত্র ,স্থানগুলো মনে হচ্ছিল আমার কত চেনা ,কত পরিচিত !একজন অতি সুদক্ষ লেখকের পক্ষেই কেবল পাঠকের হৃদয়পটে এ ধরনের অনুভূতির সৃষ্টি করা সম্ভব । "অমূলদ ডট ডট ডট" গল্পটির নামটি প্রথম অবস্থায় প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট ও বিষ্মিত করেছিল , কিন্তু গল্পটি পড়ার পর আসল ব্যাপারটুকু দৃষ্টিগোচর হয় । এইটা না হয় রহস্যৈ থাক ! মূলত সবগুলো গুলো গল্প পড়তেই আমার মনে হয়েছিল নতুন কোনো জগতের সাথে, কোনো অজানার সাথে পরিচিত হচ্ছি ।আর বলাবাহুল্য যে, গল্পগুলোর অভিনবত্ব দৃষ্টি কাড়বে যে কোনো সচেতন পাঠকেরই । পরিশেষে ,বাংলা-সাহিত্যের এই অনন্যসাধারণ সংযোজন পাঠ থেকে বঞ্চিত হওয়া এক অজানা অপূর্ণতার সৃষ্টি করবে বলে আমার ধারণা ।তাই আমার মতো বইটি পাঠ করে এর মুগ্ধতায় হারিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ রইলো ;তবে বইটি পড়া শুরু করলে মুগ্ধ করার দায়িত্বটা বইটি পালন করতে পারবে ।
Was this review helpful to you?
or
বীক্ষণ প্রান্তের সব গুলো গল্প পড়া হলেও এক সাথে রিভিউ লেখার চাইতে গল্প ধরে ধরে আলোচনা সুবিধাজনক মনে করছি এই জন্য যে, ১১ টা গল্পের বেশিরভাগই তাদের মধ্যেকার স্বকীয়তা আর স্বমহিমায় উজ্জ্বল। কিছু জায়গায় সমালোচনার জায়গা থাকতে পারে, তবে বেশিরভাগ গল্প গুলোই আসলে ভাবনার অনেক খোরাক যুগিয়েছে। বইয়ের প্রথম গল্প দিয়েই ধারাবাহিক আলোচনার একটা শুরু করার চেষ্টা করা যাক। বইয়ের প্রথম গল্পের নাম 'কিন্তু' -- নামটি যেমন অনিশ্চয়তাময় তেমনি গল্পের শেষে গিয়েও আমরা সেই অনিশ্চয়তাকে খুঁজে পাই। এছাড়াও আমরা খুঁজে পাই পিঁপড়াদের জীবন চক্র যা কিনা মানুষের সাথে রূপক আকারে তুলনীয়। গল্পটা যদি কেউ একবার স্কিম থ্রুও করেন এই দুইটা জিনিস যে কেউই খুঁজে পাবেন। তবে সেই আবেশ যদি গল্পের ভেতরে ঢুকতে বাঁধা দেয় কাউকে তিনি সম্ভবত পাঠক হিসাবে ঠকবেন। এই গল্পটি পড়ে একজন আম পাঠক হিসাবে প্রথমেই যেই বিষয়ের প্রশংসা করবো তা হলো লেখকের দেখার ওয়াইড এঙ্গেল। কমপক্ষে তিন চারটি আলাদা ডাইমেনশন থেকে গল্পটাকে দেখবার সুযোগ আছে যে জিনিসটা পাঠক হিসাবে খুবই আনন্দদায়ী। শুরু করেছিলাম মানুষের সাথে রূপকে পিঁপড়া জীবন প্রণালী দেখানোর ব্যাপারটা নিয়ে। সেটা খুব স্পষ্টভাবেই গল্পে ধরা পড়ে। সমাজের চালক শ্রেণী প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর দ্বন্দ্ব; অবশেষে ভেঙে যাওয়া তারপরে অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব। এলিট শ্রেণী থেকে ক্ষমতা আমজনতার হাতে আসা এবং আমজনতার মাঝেই কেউ এলিট হয়ে উঠা -- এই জিনিসটি আমরা দেখি যৎকোর মাঝে। আর এলিটের কাছে পদানত হওয়া কখনো সম্মানীয় হয়ে যায় নিজের মত একজনের পদানত হওয়ার চেয়ে। যৎকোর অনুসারীদের মাঝে সেই দ্বন্দ্বটা আসলে বৃটেনের রানী আর পরবর্তী দেশী রাজনীতিবিদ তুলনায় আমাদের আমজনতার মাঝেকার স্বাধীনতা আর স্বাধীনতার সুফল বিষয়ক ভাবনার দ্বন্দ্ব প্রকাশেরই আরেকটা রূপ। এই রূপকের বাইরেও দেখা যায় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব পুরাতন ভেঙে নতুনকে গড়বার চেষ্টা। সেই সাথে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই বয়ে চলা ক্রমাগত পরিবর্তন আমরা খুঁজে পাই। গল্পটা পড়লে যে কোন মনযোগী পাঠকই ধরতে পারবেন ব্যাপারগুলো চমৎকার ভাবে। গল্পের মাঝে পিঁপড়া সমাজের মাঝ দিয়ে আমাদের মানব সভ্যতার ধারাবাহিক পরিবর্তনীয় রূপ ফুটে উঠেছে। অভিজাত তন্ত্র ধনিক তন্ত্রের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তার সাথে আপোষ করা অবশেষে এলিটিজমের নাম মাত্র বেঁচে থাকা , কিংবা সময়ের প্রয়োজনে গড়ে উঠা যাযাবর জীবন অথবা গোত্র বদ্ধতার রূপও আমরা দেখতে পাই। সবচেয়ে চমৎকার ফুটে উঠেছে নিয়ম হীনতার ব্যাপারটাই। মানে প্রচলিত নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করে নিয়ম ভাঙার নেশায় মেতে ষৎকো এক সময় আবিষ্কার করে সে নিজেই এক নতুন ধরণের নিয়মের জন্ম দিয়েছে। এই জায়গাতেই অনিঃশেষতার ব্যাপারটাও চলে আসে। " কলোনীর আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার জায়গাকে ওরা পৃথিবী মনে করে। পিঁপড়ারা এক জীবনে তাই অগণিত পৃথিবী আর অফুরন্ত দেশে বাস করে" লাইন গুলো খুবই তাৎপর্য পূর্ণ। কারণ জীবনের মাঝে ছুটে চলার অসীম জগতের সন্ধান পাঠক পেয়ে যান। প্রসঙ্গ ক্রমে "আউট সাইড" গানটার কথাও মনে পড়ে। গানটার মিউজিক ভিডিওতে দেখি একজনকে দেয়ালের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে। আর তারপরে সে অপরপ্রান্তে অমিত সম্ভাবনাময় এক পৃথিবী দেখে। কিন্তু দেয়ালটা বেশ উঁচু থাকে। সেই ব্যাক্তি তিলে তিলে পাথর জমিয়ে তুলে এক পর্যায়ে সেই দেয়াল পার হয়ে যায়। তারপরে যখন অপর প্রান্তে পৌছায় সেখান থেকে আগের জায়গাকেও একই রকম সম্ভাবনাময় মনে হয়। পিঁপড়াদের পৃথিবীগুলোও এমন। নতুনের খোঁজে বেরিয়ে তারা প্রতিদিনই খুঁজে পায় নতুন পৃথিবীর, যা আমরা নিজেদের জীবনেও অনুভব করি। আর জীবনের অনিঃশেষতার কারণেই এই গল্পটির জন্ম হয় বলে মনে করা যায়। কারণ গল্পটি এক ধরণের দ্বন্দ্বের মাঝে শেষ হয়- আড়াআড়ি দেয়ালে হেঁটে চলা পিঁপড়ার অনিশ্চিত অনিঃশেষ জগত সন্ধানের মাঝে। এই দ্বন্দ্বটিকে পাশে ফেলেও জগতের মহত্তম দিকের সন্ধানকেও গল্পের একটা এঙ্গেল থেকে গুরুত্ববহ মনে হয়। ফড়িং হবার জাদুর জগতের সন্ধানের খোঁজে পিঁপড়ারা ছুটে -- এমন দৃশ্য গুলো আসলে আমাদের নিজেদের অস্বিত্বের অস্পষ্টতাকে মনে করিয়ে দেয়। এই এমবিগিটি পুরো গল্পের জন্যই খুবই গুরুত্বের দিক বলে পাঠক হিসাবে আমার কাছে মনে হয়েছে। আর অনিশ্চয়তার এই চমৎকার দৃশ্য কল্পকে পুঁজি করেই হতে পারতো শুধু গল্প। মহত্তম সত্যের সন্ধান সেই সাথে মানুষের আত্মনুসন্ধানের ব্যাপারগুলোও নিশ্চয় করে উঠে আনা হয়েছে গল্পের ছোট পরিসরে। তবে তার চেয়ে মজা লেগেছে আরেকটি দ্বন্দ্ব খুঁজে পেয়ে। " প্রকৃতির তাদেরকে প্রয়োজন আছে, কিন্তু তারা প্রকৃতির শিকার হবে না, নিহত বা নিশ্চিহ্ন হওয়ার আগে পছন্দমত জীবন কাটাবে। কিন্তু পছন্দ ব্যাপারটা ষৎকোর মধ্যে নতুন সংকটের সৃষ্টি করলো। সমগ্র জীবন তার কেটেছে খাদ্য সংগ্রহের কাজে, এর বাইরে এমন কিছু করেনি যাকে পছন্দ বলা যেতে পারে।" এই জায়গাতে ছা-পোষ জীবন আর বাধনহীন জীবন ধারণের অসমতাকেই আমরা দেখতে পাই। সারভাইবাল নামক চরম সত্য আমাদের মুখোমুখি করিয়ে দেয় ছা-পোষা জীবনের। যেই জীবন সন্ধান দেয় না কোন 'বিপন্ন বিস্ময়ের'-- তেমনি ভাবে সত্য সুন্দরকে ধারণ করতে গেলেও তা কেবল মনের আনন্দের জন্য হয় না, বরং সারভাইবালের জন্য হলেও অর্থমুখী করতে হয়। এখানে আনন্দ আর অর্থের মুখে সুন্দর ধ্বংস দুইয়ের মাঝে অসমতাকে দেখানো হয়েছে যার কোন অবজেকটিভ সমাধান কখণো পাওয়া যাবে না বরং সাবজেকটিভলি তা বিভিন্ন মাত্রায় ধারণ করে। গল্পের সবচেয়ে ভালো লাগা দিক হলো আমাদের প্রচলিত অনেক কিছু সরাসরি প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় এই গল্পটি। " মানুষের ভাষায় যেটি ধানক্ষেত, সেরকম একটি ধানক্ষেতের গোঁড়ায় তাঁদের কলোনী; গাছের উপরে কী আছে তা তাঁদের অজানা, কারণ উপরের দিকে তাকানোর ক্ষমতা তাঁদের নেই। কিন্তু তারা বিশ্বাস করে গাছের ওই ডগাটাই তাঁদের ঈশ্বর, এবং তার উদ্দেশ্যেই তারা প্রার্থণা করে।" এই লাইন গুলো পাঠক কে অস্তিত্ব ভাবনায় বেঁধে ফেলে। সেই সাথে পরবর্তীতে ষৎকোর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে খুব সূক্ষ্ম ভাবে পৃথিবীতে অধিকার করে নেওয়া সকল মতবাদের স্থান করে নেওয়ারও ইতিহাস লেখা হয়ে গেছে। এবং মতবাদ জনপ্রিয় করণের মাঝেকার সূক্ষ্ম মিলগুলোর ব্যাপারে লেখকের দেখার চোখ আর প্রকাশের গভীরতা সত্যিকার অর্থে মুগ্ধ করবার সুযোগ করে দেয়। অতঃপর তা রূপ নেয় অজ্ঞেয়তার মাঝে। " মাঝখানের কয়েকজন ভাবলো ফড়িং হয়ে তারা কী করবে; ক্রমাগত উপরে উঠে তারা কোথায় যাবে? এটাই যে জাদুর জগত তার নিশ্চয়তা কী; সর্বোপরি ওই পিঁপড়াগুলো যে তাদেরকে ধোঁকা দেয়নি তা-ই বা কে বলতে পারে।" মানুষের মাঝেকার সমসাময়িক অথবা অনেক যুগ ধরে চলা দ্বন্দ্ব গুলো খুব স্পষ্টভাবেই সামনে চলে আসে। অত:পর অনিশ্চয়তার মাঝেই শেষ হয়। হেলান দেয়ালে পিঁপড়ার হেঁটে চলা-- এটা যেন আমাদের সকলের অমোঘ নিয়তি। ওপারে কী আছে না জেনে কেবলি ছুটে চলা। কারণ পেছনে ফিরে যাওয়া অর্থহীন। বরং সেই মায়ার জগতের খোঁজে শেষ করা যাক না কেন জীবন। এই অনিশ্চিত অথচ অর্থহীন এক নিয়তির মাঝেও সেই খাড়া দেয়াল বেয়ে চলার প্রক্রিয়া ষৎকোর মত আমাদের কাছেও চরম তাৎপর্যমণ্ডিত। " চলতে চলতেই একদিন না একদিন পাওয়া যাবে জাদুর জগতের শেষ প্রান্ত, এবং তারপরে সে হবে ফড়িং" পাঠক হিসাবে অনুভূতি অসাধারণ। চমৎকার গল্পের জন্য টুপি খোলা অভিবাদন হিমালয়।
Was this review helpful to you?
or
লেখকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ বীক্ষনপ্রান্ত।প্রথম বইটি পরা হয়নি। বীক্ষনপ্রান্ত ও অনেক পরে পরা হল। ফ্ল্যাপে লেখা কথাগুলো পরে লেখকের লেখার সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা জাগে। প্রথম গল্প ‘কিন্তু’।কিন্তু’ একটি কল্পনাশ্রিত,আধুনিক রূপকধর্মী গল্প।‘ষৎকো’ নামের এক পিঁপড়া এ গল্পের প্রধান চরিত্র।ষৎকোর বিপ্লবের গল্প নিয়েই বেড়ে উঠেছে ”কিন্তু” গল্পটি।স্বতন্ত্র পরিচয়ের উদ্দেশ্যে ষৎকো তার দল নিয়ে কলোনী ছেড়ে আচমকা একদিন বেরিয়ে পড়ে জাদুর জগতের খোঁজে। শেষ পর্যন্ত সে একাই ফড়িং হবার অনন্ত পথে উঠতে থাকে।এখানে লেখক পিপড়ের মাধ্যমেই মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিকের প্রকাশে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। দ্বিতীয় গল্প "ধাঁধায় দ্বিধা"।"ধাঁধাঁয় দ্বিধা" গল্পে লেখক মানুষকে শুদ্ধ করার এক অভিনব পন্থার কথা বলেছেন।সেজন্য পরিবর্তন দরকার সমাজব্যবস্থা, প্রশাসনব্যবস্থা আর শিক্ষাব্যবস্থার।এই গল্পে লেখক মূলত অসংখ্য ধাঁধাঁ সমাধানের মাধ্যমে নতুন, পরিপূর্ণ সমাজ এবং রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন। পরের গল্প ‘৩য় বন্ধনী’।শরিফুল রিংকিকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়।সে তার বাবা জহুরুল আর মাকে রাজিও করায়। কিন্তু হঠাৎ করেই শরিফুলের বাবা জহুরুল বেঁকে বসেন।তিনি চান তার ছেলের বিয়েতে কোন স্বর্ণের আদানপ্রদান হবে না, কোন দেনমোহরের ব্যাপার থাকবে না।এর প্রধান কারণ শেষ বয়সে এসে নতুন আঙ্গিকে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ। পরের গল্প ‘অমূলদ ডট ডট ডট’।এই গল্পে সবার মোবাইলে, ই-মেইলে একটা অদ্ভুত ম্যাসেজ আসছে যেখানে লেখা so, what is it behind the crow? তারপর ধীরে ধীরে সমস্ত শহর কাকের বিজ্ঞাপন, ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টারে ছেয়ে যায়।কিন্তু কেন...এই রহস্যের জট খুলবে 'মূলদ অমূলদ ডট ডট ডট' গল্পে। পঞ্চম গল্প ‘গ্রে স্কেচ’ ।এই গল্পে দেখানো হয় একজন তরুণ লেখক কুণ্ডেরার উপন্যাস অনুবাদ করতে গিয়ে নানারকম বিড়ম্বনার সম্মুখীন হন।একজন নতুন লেখক যেভাবে অবহেলা ও প্রতারণার শিকার হন তা এই গল্পে সহজে উঠে আসে। পরের গল্প ‘বরফবিম্ব’।লেখক এই গল্পে রওনক মিশকাত নামক একটি চরিত্রের মাধ্যম।মানুষ আসলে কীসের খোঁজে পৃথিবীতে এসেছে...এই দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। সপ্তম গল্প ‘কর্মচারী যজ্ঞ’।আফসার আহমেদ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি একজন খুবই সফল ব্যাবসায়ী। সারাজীবন তার অধীনে হাজার হাজার কর্মচারী কাজ করেছে আর তিনি তাদের বিভিন্নভাবে ছাড় দিয়ে আজীবন মহৎ সাজার অভিনয় করে গেছেন।দীর্ঘদিন মহৎ মানুষের তকমা গায়ে এঁটে থাকা ব্যক্তির কাধ থেকে ক্রমেই যদি মহত্মের ভার নেমে যেতে থাকে, তাহলে তার মানসিক পরিণতি কেমন হয়,কখনো কখনো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।এমনই এক কাহিনী নিয়ে এই গল্প। পরের গল্প ‘গল্প গবেষণা প্রকল্প’।এখানে লেখক গদ্যের ভিতরে ছন্দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন।ছোট পরিসরে লেখা হলেও ‘অন্তরক’ এবং ‘চা-মামা’ গল্প দুটি বেশ ভালই হয়েছে। নবম গল্প ‘গ্যাডফ্লাই’।কাশেম গ্রামের মেম্বার নির্বাচনের প্রার্থী। সে এই নির্বাচনে জয়লাভের জন্যে যে কোন কিছু করতে রাজি।হাশেম যখন বলছিল সে গ্রাম থেকে সব দুর্নীতি তাড়াতে চায় এবং সে যখন নিজেকে মাছির সাথে তুলনা করল তখন পাঠকের সক্রেটিসের গ্যাডফ্লাইয়ের কথা মনে পড়ে। দশম ও শেষ গল্প ‘ঢ়-তত্ত্ব’।বাকি গল্পগুলোর মত এটিও অসাধারন গল্প। দাম কিছুটা বেশি মনে হলেও এই বইটা পাঠকদের অবশ্যই ভালো লাগবে।
Was this review helpful to you?
or
মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয় রচিত ‘বীক্ষণ প্রান্ত’ বইটি একটা ছোটগল্পের সংকলন। বইটি অন্যরকম প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং বইটির প্রচ্ছদ করেছেন রুবেল শাহ্। বইটিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের দশটি চিন্তা-উদ্রেককারী ছোটগল্প স্থান পেয়েছে। আলোচ্য বইটির লেখক তাঁর সময়ের সীমানাকে অতিক্রম করে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছেন। এই বইটিতে লেখক আমাদের সমাজে সাদা চোখে সচরাচর যেই ঘটনাগুলো চোখে পড়ে তার ছবি আঁকেন নি। বরং তিনি তার কল্পনাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন যতদূর সম্ভব। লেখক কখনও তাঁর নিজস্ব আদর্শের ভিত্তিতে গল্পের আশ্রয়ে সমাজ নির্মাণ করেছেন, কখনও রূপকের আশ্রয় নিয়ে দক্ষ শিল্পীর মত মানবমনের গলি-ঘুপচির ছবি এঁকেছেন। আমাদের এই উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটেই এই ধরনের ছোটগল্পের চর্চা বিরল। আর বাংলাভাষায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং হাসান আজিজুল হক ছাড়া এই ধরনের বিশ্লেষণধর্মী, ইঙ্গিতাশ্রয়ী বিষয়বস্তু নিয়ে আর কেউ গল্প লিখেছেন বলে মনে পড়ছে না। স্বপ্ন-কল্পনার তুঙ্গে উঠে গল্প লেখা এবং চিন্তা, বুদ্ধি, আলোচনার জন্যে গল্পকে খুলে দেয়া এই দুটি প্রবণতাই ব্যাপকভাবে মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়ের গল্পে দেখা যায়, যা এই সময়ের বাংলাভাষার লেখকদের মধ্যে অত্যন্ত বিরল। ভবিষ্যতে হয়তো অনেক লেখকের লেখায় এই মাত্রাগুলো সংযজিত হবে যেটা আমরা মাহফুজ সিদ্দিকী হিমলয়ের লেখায় বেশ আগেভাগেই দেখতে পাচ্ছি। তাই শুরুতেই বলেছিলাম তিনি তাঁর সময়ের থেকে এগিয়ে গিয়েছেন। যাই হোক, আমরা এবার সরাসরি গল্পগুলোর বিশ্লেষণে চলে যাই। আরেকটা ব্যাপার, দশটি গল্পর প্রত্যেকটিই যেহেতু ভিন্ন পটভূমিতে, ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা এবং তাদের গন্তব্যও ভিন্ন তাই এই বইয়ের প্রত্যেকটি গল্প আলাদা আলোচনার দাবী রাখে। ১। কিন্তু : বীক্ষণ প্রান্ত বইয়ের প্রথম গল্প ‘কিন্তু’। আসলে গল্প বললে বোধহয় এর আবেদনকে পুরোপুরি বোঝান সম্ভব হয়না। ‘কিন্তু’ হল এই বই পড়তে গিয়ে আমার সামনে খুলে যাওয়া প্রথম জানালা যা আমার বহুদিনের অর্জিত বীক্ষণ প্রান্তকে কিছুটা হলেও নাড়া দিতে সমর্থ হয়েছে। ‘কিন্তু’ গল্পটা পড়া শুরু করেছিলাম কিছুটা আনমনে। কিন্তু যখন গল্পের হাত ধরে কিছুটা পথ হাঁটা হয়ে গেল আর এ পথচলার আসল লক্ষ্য সম্পর্কে কিছু আন্দাজ করতে পারলাম তখনি পুরোপুরি সচেতন হয়ে গেলাম। রুদ্ধশ্বাসে পুরো গল্পটা পড়ে ফেললাম। কিন্তু পুরো গল্পটা পড়ার পরেও চিন্তাগুলো কেমন জানি বিচ্ছিন্ন রয়ে গেল। আমি খুব উঁচুমানের পাঠক নই, তারপরও কোন গল্প পড়ার পর আমার সাধারণত এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় না। ‘কিন্তু’ পড়ে শেষ করার পর আমি খুব অস্থিরবোধ করতে লাগলাম। যেন কতগুলো গতিশীল অসংযুক্ত বিন্দু আমার চারপাশে পরিভ্রমণরত, আমাকে কিছু ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি সেই ইঙ্গিত বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে সম্পূর্ণ গল্প, এর বিন্যাস এবং পরিণতি আমি আবার ভাবলাম। আর তখনি আমার সামনে পুরো গল্পটা তার সামষ্টিক রূপ নিয়ে উপস্থিত হল। আমার সেই উপলব্ধিই এখানে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। ‘কিন্তু’ একটি কল্পনাশ্রিত, দ্রুতগতির আধুনিক রূপকধর্মী গল্প। এখানে পিঁপড়ার জীবনযাপন এবং জীবনদর্শনের আশ্রয় নিয়ে মূলত মানুষের কিছু সহজাত বৈশিষ্ট্য এবং মানবসভ্যতার হাজার হাজার বছরের পুরনো কিন্তু এখনও একইরকম গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। এই গল্পের মূল বা কেন্দ্রীয় চরিত্র ষৎকোর নামের একটি পিঁপড়া। সে সাধারণ জীবনযাপন করতে করতে হঠাৎ করেই কলোনির খাদ্য সংগ্রহ ইউনিটের প্রধান নির্বাচিত হয় এবং সেই সূত্রে ষৎকোর নামপ্রাপ্ত হয়। নাম পাবার সাথে সাথেই তার চিন্তাজগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সে জীবনের অর্থ, সার্থকতা খুঁজতে থাকে। নিয়তিকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টায় নিমগ্ন হয়। লেখক এই পিঁপড়ার জীবনের দ্বারা আসলে শিল্পীর সূক্ষ্ম তুলিতে মানুষের জীবনের ছবি আঁকারই চেষ্টা করেছেন। মানুষও একইভাবে তার জীবনের পথে কোন এক ঘটনার মাধ্যমে যখন প্রবলভাবে আলোড়িত হয় তখন জীবনের উচ্চতর অর্থ খোঁজার প্রয়াস পায়। তারপর লেখক ষৎকোরের জীবনের মধ্যে দিয়ে মানবজীবনের প্রতিটা দিক ছুঁয়ে গেছেন, যা সচেতন পাঠকের চোখ এড়াবার কথা নয়। তিনি পিঁপড়াদের ভেতরের শ্রেণী সংঘাতের চিত্র তুলে ধরেছেন। তারা কিভাবে অর্থনৈতিক প্রাপ্তির আশায় তথা নিজেদের আখের গুছিয়ে নেবার আশায় বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে অংশ নেয় তার হালহলিকত তুলে ধরেছেন। পিঁপড়াদের ভেতরে যে লিঙ্গ-বৈষম্য তাও এ গল্পে উঠে এসেছে। আসলে এগুলো সবই মানবচরিত্রের বিভিন্ন দিক, মানবসমাজের চিহ্নিতকারী বৈশিষ্ট্য। তবে এই গল্পের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হল পিঁপড়াদের ভেতরের স্রষ্টা জিজ্ঞাসার এবং সৃষ্টি দর্শনের অংশটুকু। গল্পের এক অংশে দেখা যায় সব পিঁপড়া ধান গাছের আগার দিকে মুখ করে প্রার্থনা করছে। কারণ ওই ধানগাছের গোড়াতেই তাদের সম্পূর্ণ কলোনি। ওই ধানগাছটাই তাদের পুরো পৃথিবী আর সেই ধানগাছের ডগাটাই তাদের স্রষ্টা। এইরকম আপাত অদ্ভুত কিন্তু গভীরতর অর্থে মানুষের চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিছু খণ্ডচিত্র নিয়েই এই ‘কিন্তু’ গল্পের সৃষ্টি। কিন্তু গল্পটি শেষ হয়, ষৎকোর নামের পিঁপড়াটির জগতের অসীম রহস্য উন্মোচনের আশায় নিরন্তর একটা হেলান দেয়াল বেয়ে ছুটে চলার মাধ্যমে। এ আসলে মানুষেরই সৃষ্টিরহস্য উন্মোচনের আশায় শতাব্দীর কর্কশ পথ বেয়ে ছুটে চলা যেন। কিন্তু এ পথে যাবার সময় ষৎকোরের সহযাত্রীরা একে একে তাকে ছেড়ে চলে যায়, যেভাবে সৃষ্টিরহস্য খুঁজে ফেরা মানুষেরা নিঃসঙ্গ হয় ষৎকোরও তেমনি নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। ২। ধাঁধাঁয় দ্বিধা : এই গল্পটি আগের গল্পটি থেকে অনেক অর্থেই সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তবে যেই ব্যতিক্রমটা শুরুতেই চোখে পড়ে তা হল, ‘কিন্তু’ গল্পটি শুরু হয়েছিল একটু ধীরলয়ে। কিন্তু ‘ধাঁধাঁয় দ্বিধা’ গল্পের শুরুতেই একটি প্রশ্ন বা ধাঁধাঁও বলা যেতে পারে পাঠককে নাড়িয়ে দেয়, তা হল, পাপ, অপরাধ আর অন্যায় কি সমার্থক? পুরো গল্প জুড়েই এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে অসংখ্য ধাঁধাঁর আদলে। এই গল্পে লেখক আসলে একটি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। তিনি তার কল্পলোকের সেই সমাজব্যবস্থাকে বেশ সুচারুভাবেই তুলে ধরেছেন গল্পে। আলভেরি পানচেনি গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। গল্পের শুরুতেই দেখানো হয় সে একটা অপরাধ করে। তারপর সেই অপরাধের শাস্তিস্বরূপ লেখকের সেই কল্পিত জগতে পানচেনিকে কিছু ধাঁধাঁর সম্মুখীন হতে হয়। একই সমান্তরালে চলতে থাকে লেখকের সেই স্বপ্নের রাজ্য নির্মাণের কথকতা। সেই রাষ্ট্রের আইন কেমন হবে, শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে তার বিশদ ব্যাখ্যা। হঠাৎ করেই আমরা লক্ষ্য করি পানচেনির এক অদ্ভুতুড়ে মনোজগত। আমরা দেখতে পাই এই প্রচণ্ড প্রতিভাবান ছেলেটি ধাঁধাঁর সমাধান করার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ খুঁজে পেয়েছে, আর সেই আনন্দকে পাবার আকাঙ্ক্ষা তাকে আরও অপরাধ করতে প্রলুব্ধ করছে। কিন্তু সেই রাষ্ট্রের সব কিছুর হর্তা-কর্তা হিউম্যান রিসোর্স স্কুল পানচেনির এই দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে তাকে এমন এক ধাঁধাঁর মুখোমুখি করে যার কোন সমাধান নেই। কিন্তু এই কাজ করার পর হিউম্যান রিসোর্স স্কুল নিজেরাও ধাঁধাঁয় পড়ে যায়। পানচেনির মত প্রতিভাবান অপরাধীকে যদি তারা ধাঁধাঁর ভেতরে আবদ্ধ করে রাখে, তাহলে তার মত অপরাধী কেন তৈরি হয় সেই ধাঁধাঁর সমাধান করবে কে? এই জটিল ধাঁধাঁর পাকচক্রেই একসময় গল্পের কাহিনী পরিণতি লাভ করে। ‘ধাঁধাঁর দ্বিধা’ গল্পে লেখক আমাদের সমগ্র সিস্টেমকেই ভেঙে-চুরে নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন এক অদ্ভুত রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে। একইসাথে এই গল্পে তিনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত তারও বেশ স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। সর্বোপরি তিনি গল্পাশ্রমে ভ্রমণ অংশেও লিখেছেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনেক গবেষণা করার অবকাশ আছে। আসলে এই গল্পে লেখক মূলত অসংখ্য ধাঁধাঁ সমাধানের মাধ্যমে নতুন, পরিপূর্ণ সমাজ এবং রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন। যারা আমরা বদলে যাওয়া রাষ্ট্র-সমাজের কথা ভাবতে ভালোবাসি, তারা অবশ্যই এই কল্পনাশ্রয়ী গল্পটি পড়ে আনন্দ পাব এতটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। ৩। ৩য় বন্ধনী : গল্পটি পড়তে গিয়ে আমার সর্বপ্রথম যে কথাটি মনে হয়েছে তা হল, এই গল্পটি সংকলনের ৩য় গল্প আবার গল্পটির নামও ‘৩য় বন্ধনী’। এটা কি শুধুই একটা কাকতালীয় ব্যপার নাকি গল্পকার বুঝে-শুনেই কাজটি করেছেন? আর দশটা সাধারণ গল্পের বই হলে এটা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন বোধ করতাম না, কিন্তু ‘বীক্ষণ প্রান্ত’ ইঙ্গিত আশ্রয়ী এমনই শক্তিশালী একটি বই যে এর প্রতিটি অনুষঙ্গই বিবেচনার দাবি রাখে। আমার কাছে জহুরুলকে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মনে হয়েছে। গল্পর শুরুটা খুবই আটপৌরে। শরিফুল রিংকিকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সে তার বাবা জহুরুল আর মাকে রাজিও করায়। কিন্তু হঠাৎ করেই শরিফুলের বাবা জহুরুল বেঁকে বসেন। তিনি প্রচলিত রীতিতে ছেলেকে বিয়ে দিতে চান না। তিনি চান তার ছেলের বিয়েতে কোন স্বর্ণের আদানপ্রদান হবে না, কোন দেনমোহরের ব্যাপার থাকবে না। কিন্তু কেন জহুরুল সাহেবের এই আকস্মিক পরিবর্তন? এর পিছনে কোন দর্শন তার ব্যক্তিমানসের পট পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে সেই বিষয়টিই ‘৩য় বন্ধনী’ গল্পটির মূল প্রতিপাদ্য। খুব হালকা মেজাজে শুরু হওয়া গল্পটিতে হঠাৎ করেই গভীর দর্শন ঢুকে পড়ে। বর্তমান বিশ্বে বহুল প্রচলিত বিয়ে নামক যেই প্রতিষ্ঠান তাকে চাল্যেঞ্জ জানান হয় খোকা নামের একটা চরিত্রের মাধ্যমে। বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কিনা বা বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটি আসলেই টিকে থাকতে পারবে কিনা এইরকম বিবিধ ব্যাপার উঠে আসে গল্পের ছলে। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা প্রথা আর রীতিনীতির কাছে মানুষ কেমন অসহায় বা সামাজিক রীতিনীতির পরিবর্তনের কথা বলা যেমন সহজ, পরিবর্তন আনাটা ততটাই কঠিন এই ব্যাপারগুলোও গল্পে উঠে আসে। এই গল্পে আরেকটি ব্যাপার মোটা দাগে উঠে আসে তা হল, সমাজের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, প্রথা এসব সৃষ্টি যেমন হয় মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে তেমনি এই বিষয়গুলোর চর্চা এবং লালনও করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। এই গল্পের আরেকটা লক্ষণীয় দিক হল এর অনুচ্ছেদগুলোর নাম বাংলা বর্ণের বিভিন্ন অক্ষর দিয়ে। এবং প্রতিটি অনুচ্ছেদেই তৃতীয় বন্ধনীর ভেতর লেখক মজলিশি ভঙ্গিমায় পাঠকের কাছে থেকে গল্প পড়া অবস্থায় কী রকম প্রশ্ন আসতে পারে সেটা কল্পনা করার চেষ্টা করেছেন এবং দ্বিতীয় বন্ধনীর ভেতরে সেই প্রশ্নগুলোর বেশ মজার মজার উত্তরও দিয়েছেন। তবে এটা পরিষ্কার যে আগের দুটা গল্পের তুলনায় লেখক এই গল্পে বেশ স্পষ্টভাবেই তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন। সব মিলিয়ে গল্পটি চিন্তাশীল পাঠককে ভাবিয়ে তোলার মত। ৪। অমূলদ ডট ডট ডট : এই গল্পের শুরুতে কিছুটা রহস্যের আভাস পাওয়া যায়। যদিও সামনে এগোনোর সাথে সাথে গল্পের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যগুলো একটা একটা করে দৃষ্টিগোচর হয়। এই গল্পে দেখানো হয় একটা সবার মোবাইলে, ই-মেইলে একটা অদ্ভুত ম্যাসেজ আসছে যেখানে লেখা so, what is it behind the crow? তারপর ধীরে ধীরে সমস্ত শহর কাকের বিজ্ঞাপন, ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টারে ছেয়ে যায়। কিন্তু এই অদ্ভুত কাক-রহস্যের মূলে কী রয়েছে? এই রহস্য সমাধান করতে গিয়েই একুশ শতকের সমাজে কনজুমারিজমের ক্লেদাক্ত পদচারণা আমাদের সামনে ফুটে উঠে। বর্তমান সময়ে পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্যে নানারকম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন হল পণ্যের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু বিজ্ঞাপন যেখানে প্রতীকের আশ্রয় নিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আবেগকে পুঁজি করে বিজ্ঞাপনকে জনপ্রিয় করা হয়। লেখক এই ধরনের কনজুমারিজমের প্রতি তীব্র কটাক্ষ করেছেন ‘অমূলদ ডট ডট ডট’ গল্পের মাধ্যমে। গল্পে রুপায়ণের বাবা এই ধরনের একটা বিজ্ঞাপন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন এবং এই কারণেই হয়তো গল্পের শেষে রুপায়ণকে খেদের সাথে বলতে শোনা যায় তার বাবা দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যম হিসেবে কাককে বেঁচে নিয়েছেন কারণ কাক ময়লার ডাস্টবিন ঘেটে কাড়াকাড়ি করে খাবার সংগ্রহ করে। ঠিক একইভাবে রুপায়ণের বাবা তথা পণ্যের প্রচারকগোষ্ঠী মানুষের সরল আবেগের সুযোগ নিয়ে, মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে কাকের মতই নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা করে তাদের পেশাগত এবং অর্থনৈতিক সুবিধা খুঁজে নিচ্ছেন। এই গল্প আরেকটি বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সেটা হল মানুষের মনে একটা ছবির প্রভাব কতখানি হতে পারে, বিশেষভাবে যখন মানুষ ছবিটার সঠিক অর্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়। তবে সবদিক বিবেচনায় নিলে বলতে হয় এই গল্পটি আগের তিনটি গল্পের তুলনায় কিছুটা দুর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়ানো। ৫। গ্রে স্কেচ : ‘গ্রে স্কেচ’ গল্পটি লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের একটা বিষাদময় অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে লেখা কাহিনী বলেই আমার ধারণা। এই গল্পে দেখানো হয় একজন তরুণ লেখক কুণ্ডেরার উপন্যাস অনুবাদ করতে গিয়ে নানারকম বিড়ম্বনার সম্মুখীন হন। এবং এই বিড়ম্বনার কথাগুলো মূলত অনুবাদকটির সাথে তার ছোট ভাই সুনু, বন্ধু প্রভাত এবং সহকর্মী রুবেল শাহ্র কথোপকথনে উঠে এসেছে। আর সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হল, অনুবাদক একসময় মূল লেখকের সাথে এক অদ্ভুত একপাক্ষিক মানসিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। আসলে মূল কৃতিত্বটির দাবীদার কে – লেখক না অনুবাদক? এমন বিষয় নিয়েও ভাবতে দেখা যায় এই গল্পে। যদিও আমার ব্যক্তিগতভাবে এই চিন্তাটিকে খুব হাস্যকর মনে হয়েছে। লেখক এবং অনুবাদকের কৃতিত্বের পরিমাপ আসলে আলাদা মাপকাঠিতে হয়ে থাকে। এখানে সংঘাতের প্রশ্নই আসে না। এই গল্পে আরেকটা দিক বেশ স্পষ্ট ভাবে উঠে এসেছে তা হল, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে উঠতি লেখকদের যেই সব প্রতিবন্ধকতা পেরোতে হয় তার মর্মস্পর্শী গল্প। একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক বার বার একই পটভূমি, উপমা বা গল্পবিন্যাস ব্যবহার করলে বলা হয় এটা তার স্টাইল। এবং সেই লেখককে এই জন্যে বাহবা দেয়া হয়। অথচ একই কাজ কোন উঠতি লেখক করলে বলা হয় পুনরাবৃত্তি। এবং সেই উঠতি লেখককে বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়া হয়। তাছাড়া অনুবাদক বেশীরভাগ সময়েই সাফল্যের ক্ষেত্রে সাফল্যের অংশীদার না হলেও, ব্যর্থতার সময় ঠিকই ব্যর্থতার সম্পূর্ণ ভার নিজের কাঁধে নিতে হয়। এখন এই বিষয়গুলো নিয়ে এখন নতুন করে ভেবে দেখার সময় এসেছে। সব মিলিয়ে বলা যায় যাদের লেখালেখির আগ্রহ আছে তারা গল্পটা দারুণ উপভোগ করবেন। আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে গল্পটা খুব ভালো লেগেছে। ৬। বরফবিম্ব : এই গল্পে লেখক মূলত মানুষের অস্তিত্ব বীক্ষণ ও আমাদের চেতনার জগতে আসার আগে ও পরে অর্থাৎ চেতনার জগতের দুই পাশে যে দুইটি জগত আছে সেই জগতকে খুঁজে ফিরেছেন। লেখক গল্পের শুরুতেই মাত্রা ফিরিস্তি নামে মাত্রা নিয়ে কিছু কথা বলেছেন যেটা অনেকের কাছেই বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে। লেখক এই গল্পে তিনটি জগতের প্রসঙ্গ এনেছেন – চেতনার জগত, চেতনার জগতে আসার পূর্বের ও পরের জগত এবং একটি মধ্যবর্তী জগত। লেখক পরবর্তীতে গল্পের অনুচ্ছেদগুলোর নামকরণও করেছেন এই মাত্রাগুলোর আলকেই। তবে আমার কাছে মধ্যবর্তী জগতটাকে অহেতুক সৃষ্টি করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। গল্পের কাহিনীর প্রয়োজনে এই জগতটি অর্থাৎ মাত্রা ফিরিস্তি অনুসারে a জগতটি পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। কিংবা এমন হতে পারে এই জগতটি নিয়ে লেখক যেভাবে চিন্তা করেছেন ঠিক সেভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পারেননি। অন্তত এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায় আমার সামনে তুলে ধরতে পারেননি। এই গল্পে লেখক সৃষ্টি রহস্যের দিকে সূক্ষ্মভাবে আলোকপাত করেছেন, মানুষের মৃত্যুর পর তার দেহের পরিণতি কী হয় সে বিষয় নিয়েও ভেবেছেন এমনকি গল্পের শেষের দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের দরুণ কিভাবে পৃথিবীর মানচিত্র পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে সে ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। এছাড়া গল্পের খাঁজে খাঁজে মৃত্যুচিন্তা, মানুষের শিকড় সন্ধানী মনোভাব এসবও বেশ স্পস্তভাবেই ফুটে উঠে। লেখক এই গল্পে রওনক মিশকাত নামক একটি চরিত্রের মাধ্যমে ‘মানুষ আসলে কীসের খোঁজে পৃথিবীতে এসেছে, সে কি শুধুই একটা খেলনা খুঁজে ফিরছে?’ এই দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তবে এর উত্তর আসলে লেখকের কাছেও নেই বোধহয়, সেই কারণে প্রশ্নটি শেষপর্যন্ত ধোঁয়াশায় আচ্ছন্নই থেকে গেছে। তবে আমার কাছে মনে হয়, এই গল্পের পিছনে লেখকের যেই দার্শনিক চিন্তাগুলো কাজ করেছে তা নিঃসন্দেহে আগের গল্পগুলোর তুলনায় মহৎ হলেও লেখক সেই চিন্তাগুলোকে সঠিকভাবে বিকশিত করতে পারেননি। এই গল্পটি নিয়ে আরও অনেক ভালো কাজ করার জায়গা ছিল। ৭। কর্মচারী যজ্ঞ : মানুষের ভেতরে যেই অবস্তুগত অনুভূতি রয়েছে – রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, ভালবাসা, মহত্ত্ব এগুলোর কোনটারই তো কোন পরম মানদণ্ড নাই। মানুষ কি তাহলে মহত্ত্বকে অর্জন করার চেষ্টা নিষ্ঠুর উপায়ে করতে পারে না? এইরকম এক প্রেক্ষাপটেই গল্পটা লেখা। আফসার আহমেদ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি একজন খুবই সফল ব্যাবসায়ী। সারাজীবন তার অধীনে হাজার হাজার কর্মচারী কাজ করেছে আর তিনি তাদের বিভিন্নভাবে ছাড় দিয়ে আজীবন মহৎ সাজার অভিনয় করে গেছেন। কিন্তু শেষ বয়সে তিনি যখন ব্যবসা ছেলেদের হাতে ছেড়ে দিয়ে খামারবাড়িতে চলে এলেন, তখন তার মহত্ত্ব অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল খামারবাড়ির কেয়ারটেকার সোবহান। কারণ সোবহান খামারবাড়ির কর্মচারীদের কোন অন্যায় করার সুযোগ দিতেন না বলে, আফসার সাহেব তার মহত্ত্বের প্রকাশ ঘটাতে পারতেন না। ফলে আফসার সাহেব তার হারানো লোকদেখানো মহত্ত্বকে ফিরে পাবার জন্যে এক নিষ্ঠুর কাজ করে বসেন। সেই কাজটি কি ছিল তা জানার জন্যে পাঠককে ‘কর্মচারী যজ্ঞ’ গল্পটি পড়তে হবে। এই গল্পে লেখক মূলত আফসার সাহেবের মনস্তত্ত্ব নিয়ে এক জটিল খেলায় মেতেছেন। বিভিন্ন কর্মচারী, আফসার সাহেব এবং তার স্ত্রীর বয়ানে জমাট বাঁধা ‘কর্মচারী যজ্ঞ’ গল্পটি বেশ সুখপাঠ্য। ৮। গল্প গবেষণা প্রকল্প : সংখ্যার সূত্রে গল্প বাঁধার প্রয়াস আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব উপভোগ করেছি। কারণ আমার নিজের একটা খুব বিচিত্র অভ্যাস আছে যেটা লেখকের এই প্রকল্পের সাথে বেশ প্রাসঙ্গিক। আমি মাঝে মাঝে শব্দসংখ্যা গুনে গুনে গল্প পড়ি। অর্থাৎ একটি লাইনে কতটি শব্দ আছে তা গুনি এবং সবসময় চাই প্রতিটি লাইনে যেন জোড়সংখ্যক শব্দ থাকে। যদি কোন লাইনে জোড়সংখ্যক শব্দ না থাকে তাহলে আমি দুটি শব্দকে একত্রে ধরে জোড়সংখ্যক শব্দ সৃষ্টি করি! এবার মূল সমালোচনার অংশে আসি। সংখ্যা দিয়ে গল্প বাঁধার এই প্রয়াসকে প্রশ্রয় দেয়ার কোন মানেই হয় না। এইটা একটা ছেলেমানুষী। যেখানে বর্তমান সময়ে কবিতা লেখার ক্ষেত্রেও ছন্দের গুরুত্ব কমে আসছে, মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভাব এবং পাঠকের ভাললাগার ব্যাপার সেখানে গদ্যের ভিতরে ছন্দের অনুপ্রবেশ আসলে পশ্চাতপদতার সামিল। তবে সংখ্যার হিসাবকে যদি একপাশে রাখি, তারপরে সাধারণ গল্প হিসেবে গল্পগুলোকে বিবেচনা করি তাহলে বলতেই হয় ছোট পরিসরে লেখা হলেও ‘অন্তরক’ এবং ‘চা-মামা’ গল্প দুটি বেশ ভালই হয়েছে। ৯। গ্যাডফ্লাই : গল্পে মূলত মানুষের দ্বৈতসত্ত্বা বা বাহিরের রূপের সাথে ভেতরের মানুষের পার্থক্য ফুটিয়ে তোলার একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কাশেম। সে গ্রামের মেম্বার নির্বাচনের প্রার্থী। সে এই নির্বাচনে জয়লাভের জন্যে যে কোন কিছু করতে রাজি। সে নির্বাচনে জয়লাভের আশায় কূটপরিকল্পনা সাজানোর জন্যর আবিদার কাছে আসে। কিন্তু আবিদা বাসায় না থাকায় আবিদার ছেলের সাথে হাশেমের কিছু কথোপকথন হয়। সেখানে আমরা হাশেমের উচ্চমার্গীয় দর্শন ও মনুষ্যত্বের পরিচয় পাই। কিন্তু পরবর্তীতে সেই হাশেমই যখন আবিদার সাথে বসে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে তখন আমরা তার সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র দেখতে পাই। হাশেম যখন আবিদার ছেলে অনুপকে বলছিল সে গ্রাম থেকে সব দুর্নীতি তাড়াতে চায় এবং সে যখন নিজেকে মাছির সাথে তুলনা করল তখন অনুপের সক্রেটিসের গ্যাডফ্লাইয়ের কথা মনে পড়ে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা যখন হাশেমের দুষ্কৃতিকারী সত্তার পরিচয় পাই যে নিজেই গরুর লেজ হয়ে মাছি তাড়াতে চায় তখন গল্পের শেষে লেখক পরিহাসের ভঙ্গিতেই বলেন, ‘গুডলাক গ্যাডফ্লাই’। এই গল্পকেও বেশ দুর্বল বলা যায়। এই গল্পের সমধর্মী পটভূমিতে অনেক গল্প আগেও লেখা হয়েছে। গল্পে তেমন কোন নতুনত্ব পাই নি। ১০। ঢ়-তত্ত্ব : এই গল্পের প্লট নিয়ে লেখক বেশ নিরীক্ষা করেছেন এটা সহজেই বোঝা যায়। যদিও লেখক গল্পমানচিত্রে গল্পটি কি আষাঢ়ে গল্প নাকি এই প্রশ্নটি তুলেছেন, তবে আমি গল্পটিকে আষাঢ়ে গল্প বলতে নারাজ। গল্পটি অবশ্যই একটি উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে, তবে উদ্দেশ্যটি খুব একটা স্পষ্ট নয়। গল্পটিতে এরকম একটা দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে, যখন মানুষ অন্যায়-দুর্নীতির বেড়াজালে বন্দি হয়ে এমন এক প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যাবে যে তখন মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করার সামর্থ্যও সে হারাবে। এবং এই প্রেক্ষাপটে আর কোন উপায় না পেয়ে মানুষ আদিম মানুষের জীবন বেঁচে নেবে। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হল মানুষ সেই জীবনের সাথেও বেশ ভালভাবেই মানিয়ে নেবে, আর যারা মানিয়ে নিতে পারবে তারা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই গল্পটির ব্যাপারে আসলে স্পষ্টভাবে কোন মন্তব্য করা বেশ কঠিন। তবে এই কথা বলাই যায়, এই গল্প নিয়ে পাঠকের চিন্তা-ভাবনা করার জন্যে লেখক অনেক জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। পরিশেষে বলতে হয়, এই বইটা মননশীল পাঠকদের অবশ্যই ভালো লাগবে। বইটার মলাট দেখে কী কারণে জানি না, আমার মনে হয়েছিল বইটা কিনে বোধহয় ভুলই করলাম। কিন্তু যতই বইটা পড়তে পড়তে সামনের দিকে এগিয়েছি ততই আমার সেই ভুল ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। এই বইটা আমাকে অনেক চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে। আমার বীক্ষণ প্রান্তকে (Point Of View) বেশ নাড়া দিয়েছে। সর্বোপরি, লেখক পুরো বইজুড়েই চেষ্টা করেছেন প্রথাগত গল্পের বেড়াজাল ছিন্ন করে গল্পে নতুনত্ব আনার। এই বইতে তিনি প্রচুর পরিমাণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন এবং আমার দৃষ্টিতে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সফল হয়েছেন। এই বইটির গল্পগুলোতে যেমন বৈচিত্র্য আছে, তেমনি বইটির নামকরণেও বৈচিত্র্যের আভাস পাওয়া যায়। আমাদের দেশে একটা প্রচলিত ব্যাপার হল, কোন গল্প সংকলনের বইয়ের নামকরণের সময় যে কোন একটা গল্পের নামকে বেছে নেয়া হয়। এক্ষেত্রেও মাহফুজ সিদ্দীকি হিমালয় উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি বইয়ের একটি সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য নাম দিয়েছেন। এবং সেই নামকরণ কতটা সার্থক হয়েছে তা পুরো বই পড়ার পর যে কোন পাঠকই অনুধাবন করতে পারবেন। তাই আমার অনুরোধ, যারা মননশীল পাঠক, যারা পড়া শেষ হয়ে গেলে বই ছুঁড়ে ফেলে না দিয়ে গল্পগুলো নিয়ে ভাবতে ভালবাসেন, তারা অবশ্যই বইটি পড়বেন। এতটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়, আপনারা অবশ্যই এই বইয়ে নতুনত্বের স্বাদ পাবেন।
Was this review helpful to you?
or
"ধুর ! এইসব কি লিখছে ? কিছুই বুঝি না !" বইটি কিনার পর আমার আগে আমার এক বন্ধু বইটি পড়ে এবং এই মন্তব্যটি করে । মন ও মেজাজ দুইটাই খারাপ হয়ে যায় । ভাবলাম ১৪০টা টাকাই বুঝি পানিতে গেল । বাড়িতে এসে বইটা না পড়েই বুকসেলফে রেখে দিলাম ! একদিন শুক্রবার , বাড়িতে বসে অলস সময় কাটাচ্ছিলাম । হঠাত্ করেই বইটার কথা মনে পড়লো ! সেলফ থেকে বইটা নিলাম । ভূমিকার কয়েকটা লাইন পড়লামঃ "যেহেতু বইটি আপনি স্পর্শ করেছেন.......-সেসকল কল্পনাশ্রয়ী দৃশ্যকল্পই আমার লেখনী ।" এটুকু পড়েই বুঝলাম লেখক মনে হয় খুবই অহংকারী । মনে মনে এও বললাম ,"যা লিখছ না ! সেইটা নিয়া আবার বাহাদুরী" । যদিও এ পর্যন্ত আমি বইয়ের কেবল আট-দশটা লাইন পড়েছি মাত্র ! ভূমিক পড়ে শেষ করে উত্সর্গ পত্রে আসলাম । এখানে লেখক অত্যন্ত সুন্দরভাবে , অন্তরে সূক্ষ সুঁই বিধিয়ে তার বড় বোনকে বইটি উত্সর্গ করেছেন । এর শেষ লাইনটি পড়ে মনে মনে বললাম , "নিজে ডিমের কোর্মা খাবেন খান ! আমাদের লোভ দেখিয়ে কি মজা পান ? বড় আজিব লেখক তো আপনি ! " এরপর সূচীপত্রে আসলাম । এতক্ষনে বুঝলাম , বন্ধু আমার কেন এই কথা বলছিল ? আমি "বীক্ষণ প্রান্ত" বইটি পড়ে লেখক সম্পর্কে যা জেনেছি তা হলো তিনি বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়েছেন । তবে বাংলা ভাষা নিয়ে স্টাডি করা কোন ছাত্র এমন জটিল শব্দ দিয়ে গল্প লিখবে কি না তা নিয়ে আমার মনে ব্যাপক সন্দেহ আছে ! জানিনা বাড়িয়ে বলছি কিনা , তবে আমার সেটাই মনে হয়েছে । এরপর একে একে সবগুলো গল্প পড়ে শেষ করলাম । মনে মনে বন্ধুর চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করলাম , "শালা , তোর জন্য বইটা পড়তে এত্ত দেরী করলাম !" আমার কাছে প্রত্যেকটা গল্পই অ....সাধারণ লাগল ! তবে কয়েকটি গল্পের কিছু কিছু লাইন পড়ে হাসতে হাসতে কিছু না কিছু হওয়ার উপক্রম হয়েছিল । এই যেমন [৩য় বন্ধনী] গল্পের এই অংশটুকু , ["গভীর রাতে মহল্লার সব মানুষ জমায়েত হয় তার বাড়িতে । সকলকে দেখে তিনি উত্তেজনায় কাঁপতে শুরু করেন । 'বউ মেরে ফেলেছি কিনা দেখতে আসছোস ? একটা কুকুরের যে সম্মান , সেইটুকুও তোদের নেই । আমি বিয়ে করছি এই কথা কে বলছে তোদের ? এক্ষন বলবি , নইলে খুন করে ফেলবো' । এ পর্যায়ে উত্তেজনায় বেহুঁশ হয়ে পড়লেন তিনি ।'"] এটুকু পড়ে আমিও একটুর জন্য বেহুঁশ হওয়ার হাত থেকে বেচেঁ গেছি । আসলে বইটির প্রতিটি গল্পই শিক্ষণীয় । এই যেমন , "গ্রে স্কেচ" গল্পে লেখক একজন অনুবাদকের দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন । সত্যিই তো ! একজন অনুবাদক একটা লেখা অনুবাদ করতে যে পরিশ্রম করেন তার বিনিময়ে তিনি কি পান ?অত্যন্ত সুন্দর করে অনূদীত বইটা যখন কেউ পড়বে তখন কি অনুবাদকের কথা কেউ মনে রাখবে ? তখন তো নাম-যশ হবে বইয়ের মূল লেখকেরই । আবার "ধাঁধাঁয় দ্বিধা" গল্পে লেখক মানুষকে শুদ্ধ করার এক অভিনব পন্থার কথা বলেছেন । এছাড়াও প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা যে আমাদের কতটা হিংস্র করে তুলছে সেটারও স্বরূপ তুলে ধরেছেন এই গল্পে । আর পুরো "বীক্ষণ প্রান্ত" সম্পর্কে বলতে গেলে বইটি সম্পূর্ণ আলাদা ধাঁচের ছোটগল্প সমৃদ্ধ বই । আমরা সচরাচর যেসব গল্প পড়ি সেসব থেকে এই বইয়ের গল্পগুলো সম্পূর্ণ আলাদা । আর লেখক সম্পর্কে বলতে গেলে , বই পড়ে তাকে কিছুটা অহংকারীই মনে হয়েছে ! যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি তার সাথে কখনো মিশি নাই , কখনো মিশতে পারবো কিনা জানি না । বইয়ের অনেক জায়গায় লেখক এমন ভাব ধরে লিখেছেন , যেন তিনিই সর্বেসর্বা , তিনি যা বলবেন , লিখবেন , কল্পনা করবেন তাই হবে......