User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
কবি,কথাশিল্পী,নাট্যকার—সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক,ষাটবর্ষপূর্তি উপলক্ষে আমার শ্রদ্ধা ও অভিবাদন গ্রহণ করুন।আপনি ভালো ক'রেই জানেন এক বামনপল্লীর অধিবাসী আমরা,যে-পল্লীতে অতিকায়দের আবির্ভাব দুর্লভ ও বিব্রতকর ঘটনা;এবং যদি কোনো অতিকায় আপন দুর্ভাগ্যবশত আবির্ভূত হয় মাঝারি ও নিম্নমাঝারির কীর্তনমুখর এ-পল্লীতে,তাকে আমরা নিজেদের মাপ অনুসারে কেটে নিয়ে স্বস্তি পাই।এ-কাজ আমরা ক'রে আসছি শতাব্দীর পর শতাব্দী।আপনার কথা ভাবলে আমি বোধ করি আপনার অতিকায় প্রতিভায় আমরা স্বস্তি পাই নি;তাই আমাদের মাপ অনুসারে কেটে নিয়েছি আপনাকে;–আপনার অতিকায়তা সুখকর নয় আমাদের জন্যে;আপনি যে অতিকায় তা আমরা স্বীকার করতে চাই নি;বরং আপনাকে বহু ক্ষুদ্রকায়ের থেকে ক্ষুদ্র দেখার একটি অভ্যাস আমরা গ'ড়ে তুলে স্বস্তি পাচ্ছি।অন্ধ যেমন কখনো সম্পূর্ণ হাতি দেখে উঠতে পারে না,আমরাও সম্পূর্ণ আপনাকে,সৈয়দ শামসুল হককে,দেখতে পাই নি।অন্ধদের আচরণ, আমি বুঝি, নিরন্তর পীড়ন করেছে আপনাকে;তাই আপনি মহাভারতীয় একটি শব্দ—'সব্যসাচী'–পুনরাবিষ্কার করেছেন নিজের জন্যে;নিজেকে দেখেছেন আধুনিক অর্জুনরূপে। বামনপল্লীতে অর্জুন বেমানান;তবে আমাদের ভাগ্য দু-একটি অর্জুন আমাদের পল্লীতেও জন্মগ্রহণ করে।আমরা স্বস্তি পাই,সুখী হই,একমাত্রিকতায়;আপনি বহুমাত্রিক,এটাই আমাদের অস্বস্তির প্রধান কারণ।যিনি শুধুই কবিতা লেখেন,তাঁকে আমরা বলি কবি;তাঁর নামের সাথে কবির আগে বিশেষণের পর বিশেষণ আমরা ব্যবহার করি;যিনি শুধুই উপন্যাস লেখেন,তাঁকে বলি ঔপন্যাসিক, যিনি শুধুই নাটক লেখে, তাঁকে বলি নাট্যকার;কিন্তু যিনি ঋদ্ধ করেন সাহিত্যের নানান শাখা,যিনি হন সৈয়দ শামসুল হক,তাঁকে কী বলবো আমরা ঠিক ক'রে উঠতে পারি না।কবি বলবো,না ঔপন্যাসিক, না নাট্যকার? তাঁকে এক শব্দে আমরা ডাকতে পারি না ব'লে তাঁকে দেখি খণ্ডিত ক'রে;খণ্ডিত করতে গিয়ে তাঁকে ক্ষুদ্র ক'রে তুলি গৌণদের থেকে।আমাদের খণ্ডিতকরণপ্রবণতার এক বড়ো শিকার আপনি,সৈয়দ শামসুল হক,আপনি তা জানেন,এবং তা নিশ্চয়ই আপনাকে দশকের পর দশক পীড়িত ক'রে আসছে।আপমি নিজেই জানেন কবিতা, কথাশিল্প,নাটক মিলিয়ে আপনার উচ্চতার স্রষ্টা আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে তিনচারজনের বেশি,এবং সমগ্র বাঙলা সাহিত্যেও খুব বেশি মিলবে না।আমাদের খণ্ডিতকরণরোগের বড়ো এক শিকার হয়ে আছেন মহৎ বুদ্ধদেব বসু ;রবীন্দ্রনাথের পর যাঁর সমতুল্য আর কেউ নেই;তাঁর মহিমা আমরা যেমন বুঝি না,আমরা বুঝি না আপনার মহিমাও।কথাশিল্পী হিশেবেই আপনার পরিচয় বেশি,কিন্তু আপনি যে ওই এলাকায় আমাদের প্রধানতম,তা আমরা বলি না,বলতে ভয় পাই,বা আমরা বুঝে উঠতে পারি না।আমাদের বামনপল্লীতে পুরোনোর মূল্য বেশি,আর এ-পল্লীতে কোনো কথা একবার র'টে গেলে তার থেকে আমাদের আর মুক্তি ঘটে না,চিরকাল আমাদের ওই রটনা রটিয়ে যেতে হয়।কথাসাহিত্যের কথা উঠলে আজো সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ আর শওকত ওসমানের কথা বলি,বিশেষ করে বলি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র কথা,যেনো তিনিই আমাদের শ্রেষ্ঠ,এমনকি চিরকালের শ্রেষ্ঠ,কথাশিল্পী ;আমরা এখনো ভুল ধারণার মধ্যে রয়েছি।সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ আর শওকত ওসমানের মধ্যে মুসলমানিত্বের পরিচয় লেগে আছে গাঢ়ভাবে,আর শিল্পকলার বিচিত্র সৌন্দর্যও দুর্লভ তাঁদের কথাসাহিত্যে।আর তাঁরা কি অনেকটা উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মনে রেখেই লেখেন নি তাঁদের উপন্যাসগুলো?আপনিই তো প্রথম লিখেছেন আমাদের আপত্তিকর উপন্যাস,যা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের বিব্রত করেছে;এবং দেখিয়ে দিয়েছে শিল্পকলা পাঠ্যপুস্তক নয়।আমাদের কথাসাহিত্যকে প্রথম বিচিত্র শিল্পসৌন্দর্যখচিত ক'রে তুলেছেন আপনি;এবং আপনার সৃষ্টিশীলতাও বিস্ময়কর। আপনি নিরীক্ষার পর নিরীক্ষা করেছেন শিল্প ও সৌন্দর্য সৃষ্টির;আপনার কথাশিল্প ও কবিতা ও নাটক নিরীক্ষার বিস্ময়কর বিশ্ব,যার কোনো তুলনা বাঙালি মুসলমানের মধ্যে দেখি না।সমগ্র বাঙলা সাহিত্যেও কি খুব বেশি দেখি?বাঙলা কথাশিল্পে জীবন যতোটা বড়ো হয়ে আছে,ততোটা কি বড়ো হ'তে পেরেছে শিল্পকলা ও সৌন্দর্য? তারাশঙ্কর বা বিভূতিভূষণ বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ে যতোটা জীবন পাই,ততোটা কি পাই সৌন্দর্য ও শিল্পকলা;এবং তাঁদের আজো আমরা যতোটা কিংবদন্তি ভাবি তাঁরা কি ততো বড়ো?তাঁরা কি বাঙলা উপন্যাসকে প্রথার মধ্যেই রেখে দেন নি,শিল্পকলার থেকে স্থূল জীবন নিয়েই বেশি মেতে থাকেন নি?আপনি বেরিয়ে এসেছিলেন ওই প্রথার ভেতর থেকে।শিল্পকলায় নিরীক্ষা মূল্যবান,কিন্তু নিরীক্ষা যদি শুধুই নিরীক্ষা হয়ে থাকে,তাহলে তার বিশেষ মূল্য থাকে না;শিল্পকলায় মূল্যবান হচ্ছে সফল নিরীক্ষা,যা আপনার কথাশিল্প থেকে কবিতা থেকে নাটক পর্যন্ত বিস্তৃত।আমি এখানে আপনার উপন্যাস বা গল্প বা কবিতা বা নাটকের ভাষ্য লিখতে চাই না,হয়তো কোনোদিনই লিখে উঠতে পারবো না,শুধু জানাতে চাই যে আপনার মহত্ত্ব আমি সব সময়ই উপলব্ধি করি।আপনার বাঙালিত্ব ও আন্তর্জাতিকত্ব যেমন শিল্পিত,তেমনি শিল্পিত আপনার প্রেম ও কাম এবং জীবন।আপনার কবিতার উপাখ্যানতা যেমন শিল্পিত,তেমনি শিল্পিত তার গীতিময়তা;এবং বিস্ময়কর আপনার নাটক—অলীক কুনাট্য রঙ্গের দেশে আপনি নাটককে ক'রে তুলেছেন শিল্পকলা।নাটক আমার কাছে দৃশ্যকাব্য নয়,পাঠ্যকাব্য;মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব,আর আপনার নাটকেই আমি পাই ওই পাঠ্যকাব্যত্ব—সুন্দরী নটী,সুন্দর নট,সুন্দর রঙ্গমঞ্চ বাদ দেয়ার পর যা থাকে,তাই হচ্ছে নাটক,যা পাঠ্য,যা দেখার নয়,অনুভব আর উপলব্ধির।নাটক শুধু উল্লাস আর করতালিতে সমাপ্ত নয়।আপনি যখন তৎসম থেকে চলতি যান,এবং চলতি থেকে আঞ্চলিকে,তখন যা সৃষ্টি হয়,তা হচ্ছে শিল্পকলা;এবং আপনার প্রজন্মের কেউ ওই শিল্পকলাকে আপনার মতো অনুভব করেন নি।আপনি বাঙলা গদ্যকে পরিস্রুত করেছেন,শিল্পকলা ক'রে তুলেছেন।আপনার মধ্যে আমি দেখি সৌন্দর্য আর শিল্পকলা, যা জীবনের থেকে মহৎ,এবং অবিনশ্বর। —হুমায়ুন আজাদ অগ্রন্থিত প্রবন্ধ
Was this review helpful to you?
or
ভালোবাসার রাতে—সৈয়দ শামসুল হক ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ \ প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা \ দাম: ১০০ টাকা যৌনতা আর সাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। কিন্তু একে অপরের থেকে আলাদাও হয়ে যেতে পারেনি কখনো। সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার সূত্রে এই প্রসঙ্গটি ফিরে এল আরেকবার। কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতার নাম ‘স্তন’। সেখানে এ রকম আশ্চর্য একটি স্তবক রয়েছে: নারীর প্রাণের প্রেম মধুর কোমল, বিকশিত হয়ে ওই ফুটেছে বাহিরে, সৌরভ সুধায় করে পরান পাগল।’ একই গ্রন্থের আরেকটি কবিতা ‘দেহের মিলন’, তার উদ্বোধনী বাক্যদ্বয় এ রকম: ‘প্রতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ-তরে। প্রাণের মিলন মাগে দেহের মিলন।’ না-অতি-তরুণ বয়সে লেখা এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোকে রবীন্দ্রনাথ ‘যৌবনের রসোচ্ছ্বাস’ বলে নিজের প্রতি নিজেই কিঞ্চিৎ পরিহাস করেছেন। যেন তিনি কিছুটা বিব্রত, এই ভাবে সে কাব্য-চেষ্টার ব্যাখ্যা করেননি। রবীন্দ্রনাথের পরিণত বয়সের কবিতায় কামজ উপাদানের অভাব নেই, গীতাঞ্জলির অনেক কবিতাতেই নিষিদ্ধের আমন্ত্রণ রয়েছে, যদিও তাকে নিষ্কাম প্রমাণের চেষ্টার কমতি নেই। তবে এ কথাও ঠিক, গীতাঞ্জলি-পরবর্তী কবিতায় দেহকে সম্বোধন করে, অথবা স্তন স্পর্শ কামনা করে এমন অন্য কবিতা তিনি লিখেননি। পরিণত বয়সের রবীন্দ্র কবিতায় কামজতা বিরল, কিন্তু তাঁর গল্পে ও উপন্যাসে ঠিক উল্টো। ঘরে বাইরে, চোখের বালি বা যোগাযোগ উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে সামাজিকভাবে অবৈধ এমন শরীরী প্রেম। শরীরের নিজস্ব দাবি রয়েছে, তাকে অস্বীকার করা কঠিন, কখনো কখনো মনে হয় রবীন্দ্রনাথ নিজেও সে দাবি মানেন। বিনোদিনী, বিমলা অথবা সন্দ্বীপের প্রতি তাঁর একধরনের পক্ষপাতিত্ব আছে, এমন কথা ভাবা একদম অযৌক্তিক নয়। অথচ যা সমাজবিরুদ্ধ তা অনৈতিক, এই প্রাচীন যুক্তি অনুসরণ করে তিনি বারবার ফিরে এসেছেন নিয়ম-অনুশাসনের ঘেরাটোপে। বিমলার প্রতি তিনি সুবিচার করেননি, এ কথা তো রবীন্দ্রনাথের নিজের। অনুমান করি, চোখের বালি বা ঘরে বাইরের কোনো কোনো পাঠক এর বিপরীত সিদ্ধান্তেও হয়তো পৌঁছাবেন। দ্ব্যর্থবোধকতা, সে তো রবীন্দ্রসাহিত্যের একটি পরিচিত লক্ষণ। আমরা যদি আরও কিছু সময় পিছিয়ে যাই, যেমন সপ্তম দশকে লিখিত সংস্কৃতি গাথাসমূহ, অথবা রামানুজনের অনুবাদে প্রাচীন তামিল কবিতার সঙ্গে পরিচিত হই, তাতে যে নিষিদ্ধের আমন্ত্রণ শুনি, সেখানে যে কণ্ঠধ্বনি উচ্চারিত হয়, তার ভাষা বিস্ময়করভাবে অনেক প্রত্যক্ষ ও কামজ। আরও লক্ষণীয়, এই কবিতায় অধিকাংশ সময়ের কামনাকাঙ্ক্ষায় উদগ্রীব রমণীর অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে, পুরুষের নিষিদ্ধ বাসনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে নারীর ভাষ্যে। সপ্তম দশকের সংস্কৃত কবি আমারু-র রচনা হিসেবে পরিচিত এই কবিতাটি বিবেচনা করা যাক: পদ্মলোচনা কন্যা পথের দুধারে বিছায়ে চোখ তোমার অপেক্ষায় বাড়ির ফটকে ঠেকায়ে রাখে স্তনযুগল যেন পুতপবিত্র রন্ধনপাত্র। অথবা পাঠ করা যাক রামানুজনের অনুবাদে প্রায় এই প্রাচীন তামিল কবিতাটি: মাটির পৃথিবীর চেয়েও বিশাল আকাশের চেয়েও উঁচু সমুদ্রের জলের চেয়েও গভীর তার জন্য আমার প্রেম যার বাস পাহাড়ি উপত্যকায় যেখানে মধুকর কুচকুচে কালো বৃন্তলযুক্ত কুরিঞ্চি ফুল চুষে সাজায় ঘন মিষ্টি মধু। প্রথম কবিতায় সংস্কৃত কবির নারী দেহের চিত্রাবৎ বর্ণনার মাধ্যমে পুরুষের কামবোধ উসকে দেওয়ার চেষ্টা লক্ষণীয়। স্তনকে রন্ধনপাত্র বলায় স্থূলতা থাকতে পারে, কিন্তু তার ইঙ্গিতময়তা আমাদের অগোচরে থাকে না। দ্বিতীয় কবিতা, যার উচ্চারণ নারী কণ্ঠে, তাতে রতি-বাসনার কথা প্রকাশিত হয় ইঙ্গিতে, পাঠককে তার রস আহরণ করতে হয় মধুকরের মতো। মুখে বলা না হলেও এই কবিতায় প্রেমিক-প্রেমিকার নিবিড় মিলনের কথাই বলা হয়েছে। সে উদ্দেশ্যে কবি এখানে ‘অলক্ষ্য রূপকে’র ব্যবহার করেছেন। কুরিঞ্চি ফুল থেকে মধুকরের মধু আহরণের ভেতরে লুকানো রূপকে থাকে সেই নিবিড় মিলনের ইঙ্গিত। কুরিঞ্চি গাছে ফুল ধরতে সময় লাগে ১২ বছর। এই ১২ বছর কবিতায় উল্লিখিত কিশোরীর বয়ঃপ্রাপ্তির কথা নির্দেশ করে। রামানুজন আমাদের এই ইঙ্গিতময়তা ধরিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু এই তথ্যটুকু না জানলেও কবিতার সলজ্জ কামজতা আমাদের কাছে অজ্ঞাত থাকে না। কামবোধ তাড়িত প্রেমবাসনার কথা বলা হলেও একধরনের শালীনতা বা কাব্যিক আড়াল আপাতত সরল একটি ভাবনাকেও কবিতায় রূপান্তরিত করে। হাজার বছর আগে, অথবা সম্প্রতি, কবিতায় কামজ চেতনার এই প্রকাশ ঘটেছে মুখ্যত নারীর দেহকে কেন্দ্র করে। ‘স্তন’ অথবা ‘দেহের মিলন’ আকাঙ্ক্ষা মানুষকে যেকোনো বয়সেই নিয়মভাঙায় ঠেলে দেয়, কখনো কখনো নিষিদ্ধের পথে নামার হাতছানি দেয়। বস্তুত, ফ্রয়েডের ব্যাখ্যা অনুসরণ করে আমরা অনায়াসে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে প্রেম—যা কখনোই নিষ্কাম নয়-মানুষকে পূর্ণাঙ্গতা দেয়। অতএব মানব, বয়সের কৃত্রিম বহিরাবরণে নিয়ন্ত্রিত না হয়ে, আরও গভীর, আরও গাঢ় কোনো তাড়না থেকে সে সুখ অন্বেষণ করে। পুরুষ রমণীকে কামনা করে, এ কেবল রিপুর তাড়না নয়, বরং এই উপলব্ধি থেকে যে নারীর সঙ্গে মিলনেই তার পূর্ণতা। এই মিলনেরই নাম প্রেম। ‘প্রেমের অর্থ নিহিত হূত সুখের পুনরুদ্ধারে।’ কিন্তু শুধু কামই যদি সে জগৎ-যজ্ঞের প্রণোদনার লক্ষ্য হয়, তবে প্রেমের বদলে গন্তব্য হয় নাসিসিজমে। কোনো সংবেদনশীল ব্যক্তি, বিশেষত কবির জন্য সে গন্তব্য কাঙ্ক্ষিত নয়, হওয়া উচিত নয়। কারণ, শুধু প্রেমের ভেতর দিয়েই আমরা উদ্ধার করি অপরকে, যে অপরের আয়নায় নিজেকে পূর্ণতরভাবে আবিষ্কার অথবা নির্মাণ সম্ভব। কবিতাকে যে একদিকে বাসনা, অন্যদিকে বাস্তবতার সন্ধিস্থল—তার গন্তব্য সঙ্গম বলা হয়— সে তো এই কারণেই। অক্তাভিও পাজের ‘সানস্টোন’ (পিয়েদ্রা দেল সল) কবিতার এই অংশটুকুর কথা ভাবা যাক: I go through your body as though the world, as your belly is a sunny place your breasts two churches where the blood ministers its parallel mysteries my looks cover you like ivies you are a city where the sea attacks প্রতি-তুলনায় সৈয়দ শামসুল হকের এই বাক্যগুলো অনুসরণ করা যাক: তোমার সাক্ষাতে আমি নক্ষত্রের মতো হয়ে যাই— দীপ্তিমান একটি বা দুটি নয়, কামুক আঁধারে এক লক্ষ সংখ্যায় পৌঁছাই। তবু আমি থেমে নাই। অগণন আরও লক্ষ অপেক্ষায় স্ফুটনের পরে। (ভালোবাসার রাতে, সনেট নং ২) কামের অন্য অর্থ বুনন, নির্মাণ, পতন ও ক্রমাগত সদ্ভাবনার সীমানা অতিক্রমণ। এ কথা আর কারও ক্ষেত্রে না হোক, কবির ক্ষেত্রে সত্য। রবীন্দ্রনাথ থেকে, পাজ থেকে, সৈয়দ হক তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যে এই চক্রাবর্ত আমরা প্রত্যক্ষ করি—কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো অলক্ষ্য—পুনঃপুন, অবিরত। রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতায় নারীর শরীর—সে শরীরের প্রতি নিঃশর্ত বশ্যতায়-আনন্দ শীৎকার শোনা যায় অনেকেরই কবিতায়, যদিও শিল্পের আড়ালের রক্ষণশীল শর্ত অতিক্রম অনেকের পক্ষে সহজ হয়নি। ফলে, যে ভাষায় নবম-দশম শতকের সংস্কৃত কবি অথবা ষোড়শ শতকের সহজিয়া বৈষ্ণবের পক্ষে রতিলীলার উদ্যাপন সম্ভব হয়েছে, আধুনিক বাঙালি কবি সেখানে মধ্যবিত্ত রক্ষণশীলতায় আড়ষ্ট হয়ে গেছেন। অগমের পথে তাঁরা গেছেন ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে ভালোমানুষির একটি কৃত্রিম মুখোশ ঠেসে রেখেছেন। এই ধারার এক ব্যতিক্রম সৈয়দ শামসুল হক। যৌবনের অঙ্কুরোদগমে, অথবা মধ্য যৌবনে, সর্বদাই সৈয়দ হক নারীদেহের রহস্যময়তায় নিজের অপার বিস্ময়, নিরন্তর খোঁজ ও অবশেষে তাতে সমর্পণের ভেতরে দিয়ে নিজের বাসনার নির্মিতির সঙ্গে আমাদের পুনঃপুন পরিচয় করিয়েছেন। একটি কবিতার নির্মাণ একই সঙ্গে বেদনার ও বিজয়ের, নারীদেহের প্রতি বশ্যতা ও অনুসরণ সেই রকম তীব্র ও আততি-বহ। সব কবি বস্তুত একটি কবিতাই লিখতে চান, একটি পরিপূর্ণ কবিতা—যার একমাত্র তুলনা চলে নারীদেহে, শ্বেদ ও শীৎকারে তাতে সমর্পণের সঙ্গে। একদম প্রথমাবধি, ‘বৈশাখে রচিত পঙিক্তমালা’ জ্বরাক্রান্ত উচ্চারণ থেকে শুরু করে তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ভালোবাসার রাতে-র প্রায় আহ্লাদি খুনসুটি রতিক্রিয়ার ভেতর নিষিদ্ধ ও নির্মলের আশ্চর্য সহবাসে কবির সে অভঙ্গুর বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। না অতি তরুণ বয়সে ‘রমণের লাল ইচ্ছা’ তাকে নিয়ত অনুসরণ করেছে, যেন কাঁধের ওপর চেপে বসা সে এক অ্যালবাট্রস। যখন তরুণ, ‘দাঁতের সাঁড়াশি দিয়ে’ তিনি তুলতে চেয়েছেন প্রিয় রমণীর কামনা-রাঙা ঠোঁট। একটি কবিতার নির্মাণ সম্পূর্ণ করার ব্যাগ্র ব্যাকুলতার মতোই ‘বিচিত্র বীর্যের গূঢ় রসায়ন’ তাকে হন্যে হয়ে তাড়া করেছে। পরিণত বয়সে, নারীদেহের গূঢ়রহস্য যখন তাঁর কিছু কিছু জানা হয়েছে, তখনো সে দেহের প্রতি বশ্যতার অঙ্গীকার কিছুমাত্র শিথিল হয়নি। কবিতা ও নারীদেহ, এই দুই অপার বিস্ময় এখনো তাঁকে নিয়তির মতো তাড়িয়ে বেড়ায়। নিজের স্বীকারোক্তি অনুসারে, প্রাণিত চোখে, বিষাদিত চোখে, বিস্মিত চোখে আর জীবনের ঘোরলাগা চোখে জগৎটাকে দেখে নিতে যৌবনেরই মতো এখনো যে তিনি অপল চেয়ে আছেন, কবিতাই তাঁকে সে শক্তি দিয়েছে, দিয়ে চলেছে। কবিতা তাঁর আশ্রয়, কিন্তু নারী তাঁর আরাধ্য। সে আরাধনা অথবা সেই উদ্যাপনের নির্ভীক প্রকাশ রয়েছে ‘ভালোবাসার রাতে’র মোট ৭১টি গঠনগতভাবে কিঞ্চিৎ শিথিল সনেটে। নির্ভীক বলছি এই কারণে যে নারীর দেহের কাছে এমন নিঃসংকোচ, এমন নিঃসংশয় আত্মসমর্পণ, বাংলা কবিতায় কার্যত অনুপস্থিত। অনুমান করি, কোনার্ক বা খাজুরাহোর মন্দিরগাত্রে নারীদেহ যাদের সংকোচের কারণ হয়, এই কাব্যগ্রন্থ তাদের পুলকিত করবে না। এই গ্রন্থের কবি সেই অনুমান বিষয়ে সম্যক অবহিত, কিন্তু সেই অবধান তার নিজের কোনো দ্বিধা বা দৈন্যের কারণ হয়ে ওঠে না। বরং তা জন্ম দেয় একপ্রকার করুণার ও উপহাসের। শিশ্ন আর যোনি আছে সকলেরই—তবুও অবাক, সকলেই বলেই ওটা ওই সব মনে চাপা থাক। বরং পদ্যই যদি—হোক শুধু ভালোবাসা নিয়ে, সেই ভালোবাসা যার পরিণামে লোকে করে বিয়ে। (ভালোবাসার রাতে, সনেট নং ৩৬) গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো সবই পুরুষকণ্ঠে, অতএব তা কবির নিজস্ব কণ্ঠ এমন বিবেচনা অবান্তর নয়। কবি এই বিষয়ে সম্পূর্ণ অবহিত, যে রক্ষণশীল-কিন্তু কপটাচারী মধ্যবিত্ত-পাঠকের কারও কারও কাছে তার এই খোলামেলা কামজ নিবেদন মনঃপূত হবে না। সে বিবেচনা কবিকে উদ্বিগ্ন করে না, কারণ তিনি সন্দেহ শূন্য যে নারীর প্রতি কামজ নিবেদনে বিন্দুমাত্র অনৈতিক অথবা নিরুদ্ধ কোনো সংস্কার নেই। দুই দেহের সম্মিলনে তিনি স্বর্গের আস্বাদ পান, অতএব ‘বুঝি না সেসব লেখা অপরাধ হবে কি কারণে।’ ভণ্ড গোস্বামীদের প্রতি ঠোঁট উল্টিয়ে তিনি অনায়াসেই বলতে পারেন, ‘থাকুক মানুষ তবে নিমসাধু সৌজন্যবশত; দেহের মন্দিরে আমি থেকে যাই পূজায় নিরত।’ (সনেট নং ৩৬) এই সনেটগুলোর নির্মাণ স্মৃতি থেকে নয়, তারা নয় স্বপ্নের গহনে লুকানো মণিমুক্তো খুঁজে আনার কোনো স্বমেহন। এসবই কবির পরিণত বয়সের অথবা যদি বলি প্রৌঢ় সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা। কবি এই বিষয়ে সচেতন যে কামজ অভিজ্ঞতার মাত্রাভেদ নির্ভর করে সূর্যদেবের নির্গমণপথের ওপর। তিনি মধ্য যৌবন অতিক্রম করেছেন, অথচ মিথুনের অপার আগ্রহ বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। সর্বদা সে মিথুন-চেষ্টা স্বর্গে প্রবেশে পরিসমাপ্ত হয় এমন নয়। কিন্তু তাতে তিনি থোড়াই বিব্রত। ‘শরীরে শরীর তাই! মথিত কী চেষ্টা প্রবেশের! কখনো তা সাধ্য হয়, কখনো তা পশে ব্যর্থতায়— আমার এ খিন্ন দেহে প্রেম তবু পতাকা ওড়ায়।’ (সনেট নং ৬০) এই যে সম্মিলন, তা কেবল রতির নৃত্য নয়। আসল লক্ষ্য সেই অগম অধরাকে ছোঁয়া, যাকে বলি প্রেম। দেহের ওপর অধিকার অর্জিত হলেও প্রেমের কেতন ওড়ে না। কারণ, সেখানে প্রবেশ আরও দুর্গম, কেবল আরও বন্ধুর পথ অতিক্রমণের পর সেই দুর্লক্ষ্য প্রদেশে পৌঁছানো যায়। কবির লক্ষ্য তাঁর অভিযাত্রা সেই দুর্গম পথ পেরিয়ে আরও গভীরে, আরও নিকটে আগমন। ‘দেহের ভেতর দেহ! সেই দেহ আজও খোলে নাই। এবং হূদয়-দেশে হূদয়েরও খোলেনি দরোজা। তোমার গভীরে গিয়ে প্রতিরাতে সেই শেষ খোঁজা \’ (সনেট নং ৫২) কবিতা ও প্রেম, কবির কাছে তা সমার্থবোধক ও সমান্তরাল। অনায়াসলব্ধ নয় কোনোটাই। কবি জানেন, শুধু কাম যদি লক্ষ্য হয়, সে কসরত পর্যবসিত হয় কেবল প্রতি নিশির রুটিন ওঠানামায়, তাবৎ মানবকুল সে কসরত করছে অনাদিকাল থেকে। কিন্তু সে কসরতে তো প্রাণের উন্মীলন নেই, নেই পূজা-অর্চনা শেষে মোক্ষলাভের পুরস্কার। যেমন শুধু শব্দের পর শব্দ বসালে কবিতা হয় না, কারণ তাতে প্রাণ নেই, নেই প্রণয়লহুর প্রপাত। কাব্যদেবীর আরাধনায় যতি নেই, যতি প্রেমের অভিযাত্রায়। ‘তোমার বন্দনা করি! কিন্তু এই মূঢ় কণ্ঠস্বরে যা কিছু বলি না কেন, কামুকেরই উচ্চারণ হয়। কবিতা বলবো তাকে? খুব জানি কবিতা সে নয়! শয্যায় তোমাকে পেতে ডাক দিই যে-ভাষায় আমি এখনো কবিতা নয় কণ্ঠ যদি শুধু রতিকামী \’ (সনেট নং ৪৬) এই গ্রন্থের ৭১টি সনেট এক বিষয়-নির্ভর হওয়ায় তা ক্লান্তিকর, কেউ কেউ বলবেন। রতি-আনন্দ পৌনঃপুনিকতায় পর্যবসিত হয় না, কিন্তু পাঠকের কাছে একই কণ্ঠের নিভৃত বাসনার বিভিন্ন উচ্চারণ পৌনঃপুনিকতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। কিন্তু এ কথাও তো অসত্য নয় যে নিষিদ্ধের প্রতি আগ্রহ সে পৌনঃপুনিকতা সত্ত্বেও আমাদের ক্লান্ত করে না, বরং তৃষ্ণা উসকে দেয়। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সংগৃহীত চিত্রাবলি দর্শনের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করুন। একই দেহ, তার একই প্রকাশ, অথচ কী বিপুল আগ্রহে পাঠক তাদের প্রতিটি পৃষ্ঠা অভিনিবেশিত নিষ্ঠায় অনুসরণ করেন। নারীদেহ নারীহূদয়েরই মতো দুর্জ্ঞেয়, অপরিজ্ঞাত। সে অজ্ঞাতকে অনুধাবন ও আবিষ্কার এক দীর্ঘ যাত্রার মতো, যে যাত্রা শুরু মানব-মানবীর স্বর্গ থেকে পতনের মুহূর্ত থেকে। তুমি সেই! সেই তুমি! অথচ কী বিস্ময় মানি— এতবার এত দেখা এত কথা এতবার রতি, আবার যখন দেখা, মনে হয় তুমি এতখানি অচেনা আমার—যেন, তুমি কোনো প্রথম যুবতী— (সনেট নং ৪১) ভালোবাসার রাত কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি সনেটে যে কণ্ঠস্বর শুনি, তা অনিবার্যভাবেই একজন পুরুষের, সে কণ্ঠ কখনো তৃপ্ত, কখনো উদ্বিগ্ন, এবং সর্বদাই নারীর প্রতি সনির্বন্ধ প্রার্থনারত। ৭১টি সনেটের কোথাও একবারের জন্য আমরা মনস্তাপ অথবা দ্বিধার উচ্চারণ শুনি না। শুনি না কোনো পাপবোধের উচ্চারণ। এই একই কবিতা যখন কোনো একজন নারীর হাতে রচিত হয়, সেও কি থাকে একই রকম অবিচল ও স্থির? প্রতি-তুলনা হিসেবে কমলা দাসের একটি কবিতা স্মরণ করা যাক: It is I who laugh, it is I who make love And then feel shame, it is I who lie dying With a rattle in my throat, i am sinner I am saint,, I have no joys which are not yours, no Aches which are not yours. I too, call myself I. (ইন্ট্রোডাকশন) একটি বাইনারি অভিজ্ঞতার আভাস এখানে পাই, পাই স্ববিরোধিতার আভাস। তার চেয়েও বড় কথা, নিমজ্জিত সম্মিলনেই সুখ নিহিত, এ কথার দ্বিধাহীন স্বীকৃতির পরে কবিকে জানাতে হয়, সে সুখের পূর্ণতা রয়েছে অংশীদারের। যতটুকু সে দেবে ঠিক ততটুকু তাকে পেতেও হবেও। এই দেওয়া-নেওয়ার ভেতর যে সুখ জন্মে তার একটি গার্হস্থ্য পরিকাঠামো রয়েছে। সে কারণে সে সুখ বড় দৈনন্দিন, আটপৌরে, গতানুগতিক। সৈয়দ হক সে গতানুগতিকতা পরিহার করতে চান। অতএব এই তাঁর নিশ্চিত নির্ভীক ঘোষণা, ‘যা বলে বলুক লোকে, পুত্র আমি কামদেবতার’।