User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
যৌতুক বা পণপ্রথা একটি সুপ্রাচীন সামাজিক ব্যাধি। এর ফলে প্রবহমান নারীজীবন হয়েছে বিপর্যস্ত, ব্যাহত ও সীমাহীন পশ্চাৎপদ। নারীজীবনের এ পশ্চাৎপদতার মূলে আছে জেন্ডার বৈষম্য। পিতৃতান্ত্রিক, পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সমাজ কখনোই নারীদের পারিবারিক শৃঙ্খলের জগদ্দল থেকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা করেনি। বরং বারবার সামাজিক ও অপসংস্কৃতির দোহাই দিয়ে নারীদের জীবনকে করেছে দুর্বিষহ ও ক্ষতিগ্রস্ত। সনাতন হিন্দু সমাজে ‘স্ত্রী ধন’ হিসেবে যৌতুক প্রচলিত ছিল। বাঙালি মুসলিম সমাজে এ যৌতুক ব্যাধি উনিশ শতকের পর দেখা যায়। যৌতুকের বিষফল হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজকেই করেছে যুগপৎ অনগ্রসর ও পশ্চাৎমুখী। আজও উনিশ-বিশ শতকের পরও প্রকৃত নারী স্বাধীনতা আসেনি। থেমে যায়নি আজও যৌতুক-প্রথা। আজও প্রাচীন সমাজপতিদের সেই জঘন্য প্রেতাত্মার হাত থেকে যেন আমাদের নারীরা মুক্তি পাচ্ছেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে যৌতুক প্রসঙ্গ গ্রন্থের সংকলক মালেকা বেগম। তিনি বাংলাদেশে নারী অধিকার ও আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী। নারী অধিকার ও নারী উন্নয়নের ওপর তাঁর গবেষণামূলক ২৩টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও সভানেত্রী হিসেবে নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘ ২২ বছর কাজ করেছেন, এখনো করছেন। উপযুক্ত সংকলন গ্রন্থে সংকলক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬টি যৌতুক বিষয়ের গল্প নির্বাচন করেছেন। গল্পগুলো যথাক্রমে—‘দেনা পাওনা’, ‘কঙ্কাল’, ‘স্বর্ণমৃগ’, ‘সুভা’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘মানভঞ্জন’, ‘ঠাকুরদা’, ‘দুর্বুদ্ধি’, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’, ‘নষ্টনীড়’, ‘পণরক্ষা’, ‘হৈমন্তী’, ‘অপরিচিতা’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘তপস্বিনী’ ও ‘পাত্রপাত্রী’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ছোটগল্পের জনক। তাঁর ছোটগল্পগুলো রবীন্দ্র-দর্শনের শত কোটি দরোজার উন্মোচন করেছে। গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলো তাঁর সময়োচিত চিন্তার ফসল। তিনি তাঁর সমাজদর্পণের আলোকেই নারীজীবনের বৃত্তাবদ্ধ অচলায়তনের মর্মস্পর্শী কাহিনি বয়ান করেছেন। তাই গল্পে উঠে এসেছে বহুবিচিত্র চরিত্র ও আখ্যান, নারী নির্যাতন ও নিষ্পেষণের করুণ কাহিনি। গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘দেনা পাওনা’। সংকলকের ভাষায় বাংলা সাহিত্যে এটিই যৌতুক বা পণপ্রথা নিয়ে প্রথম ছোটগল্প। রবীন্দ্রনাথ যুগ-সচেতন কথাসাহিত্যিক বলেই যুগের দাবিকে তিনি তাঁর লেখায় অগ্রগণ্যে এনেছেন। হিন্দু সমাজে পণপ্রথা ও কৌলীন্য-প্রথা নারীজীবনকে করেছে নির্যাতিত ও অবহেলিত। নারীরা সামাজিক এ ব্যবস্থার ভেতর হয়েছে অবহেলিত ও অপমানিত। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতারা সামাজিক এ বর্বরোচিত নিয়মের ভেতর হয়ে পড়েছিলেন অন্তরীণ। গল্পগুলোতে আমরা দেখি নারী অপমানিত হচ্ছে। হতাশায় দিন দিন মৃত্যুর পথে ধাবিত হচ্ছে। কেউ নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতি করছে। এসব গল্পের বাইরের জীবনেও দেখা গেছে সত্যিকারের নারীদের জীবনদানের গা হিম করা কাহিনি—আত্মহত্যা ও নির্যাতনের চিত্র। এসব নারীর জন্য কে এগিয়ে এসেছেন? কেউ কেউ এগিয়ে এসেছেন কখনো কখনো। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা কম। সংখ্যা কম হলেও এ পথে তাঁদেরই অবদান আজ উজ্জ্বল হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার মাধ্যমে সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন নারীদের প্রতি নির্যাতন আর অপমানের কথা। কখনো কখনো বিদ্রূপের কশাঘাতে জর্জরিত করতে চেয়েছেন প্রচলিত সমাজের বিধি-বিধানকে। ‘দেনা পাওন’া গল্পে নিরুপমা পণপ্রথার বলি হয়েছিল। তার পিতা রামসুন্দর ভিটেমাটি বিক্রি করেও চেয়েছিল পণের টাকা শোধ করতে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। শ্বশুরালয়ে অনাদরে-অবহেলায় নিরুপমার সম্ভাবনাময় জীবন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। তার স্বামী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য কনে পাওয়া গেল। গল্পের ভাষায়, ‘এবার বিশ হাজার টাকা পণ আর হাতে হাতে আদায়।’ ‘সুভা’ গল্পটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। জন্ম থেকেই মেয়েটি বোবা। সুভার মা মেয়ের এ ত্রুটির জন্য নিজেই দোষী বলে মনে করেন। সুভা কথা বলতে পারে না কিন্তু বিশ্বপ্রকৃতির প্রতিটি বস্তুর সঙ্গেই যেন তার কথা হয়। সমাজে একঘরে হওয়ার ভয় ও মেয়ের বয়স বেড়ে গেলে পাছে তাদের জাত যায়—এ করণে সুভার বাবা বাণীকণ্ঠ কলকাতায় মেয়েকে নিয়ে যায় বিয়ের জন্য। যথা সময়ে তার বিবাহ হয়ে যায়। সুভার বাবা-মা ফিরে আসে গ্রামে। তারা মনে করে তাদের জাতি ও পরকাল রক্ষা পেল। কিন্তু তারা অনুভব করতে পারেনি যে তারা তাদের কন্যাকে আসলে বিসর্জন দিয়ে এসেছে। অচিরেই সবাই জানতে পারল মেয়ে বোবা। তার ভাষা কেউ বুঝতে পারে না। এভাবে সঙ্গ ও সঙ্গীহীন এক পরিবেশে তার জীবন অকালে ঝরে পড়ে। তখন সুভার স্বামী ‘চক্ষু এবং কর্ণেন্দ্রিয়ের দ্বারা পরীক্ষা করিয়ে এক ভাষাবিশিষ্ট কন্যা বিবাহ করিয়া আনিল।’ ‘মানভঞ্জন’ গল্পে গিরিবালার জীবনের প্রতি স্বামী গোপীনাথের অবহেলা ও গল্পশেষে তার প্রতিশোধের কথাই ব্যক্ত হয়েছে। এ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তর্গত দ্রোহই যেন গিরিবালার নারী হূদয়ের প্রজ্বলিত হোমশিখা। গিরিবালা মনোরমা নামে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করে। দর্শকেরা তার রূপে মুগ্ধ হলেও গোপীনাথ চিৎকার করে ওঠে। দর্শকেরা ক্ষিপ্ত হলে রঙ্গলয়ের লোকেরা তাকে বের করে দেয়। এ ছাড়া ‘নষ্টনীড়,’‘স্ত্রীর পত্র,’ ‘কঙ্কাল’, ‘স্বর্ণমৃগ’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘মানভঞ্জন’, ‘ঠাকুরদা’, ‘দুর্বুদ্ধি’, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’, ‘হৈমন্তী’, ‘তপস্বিনী’ ও ‘পাত্রপাত্রী’ গল্পে পণের বিষয়টি কোথাও খুব তীব্র ও কোথাও ইঙ্গিতে ব্যক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোর ভেতরে যুগযন্ত্রণার এ পাষাণভারের কথা অকপটে বর্ণিত হয়েছে। মালেকা বেগমের ভাষায়: ‘গল্পগুলো পাঠক পড়েই বুঝবেন বাঙালি সমাজে কন্যাদায়, পণপ্রথা, যৌতুক-প্রথা কীভাবে মেয়েদের জীবনকে দুর্বিষহ করছে, নির্যাতিত করছে। প্রসঙ্গটি শত শত বছরের পুরোনো হলেও এখনো সমাজ জীবনে জীবন্ত সংকটের মতোই বিরাজ করছে।’ সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০১, ২০১১