User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
ভ্রমণ বা সফর, সে দেশ বা বিদেশের মাটিতেই হোক, হোক না তা যেকোনো উপলক্ষেই, তার সঙ্গে রম্যরসের যোগ যেন অঙ্গাঙ্গী। প্রকৃত ভ্রমণ-সাহিত্যের শরণ নিলে বাংলা সাহিত্যেও এর প্রমাণ মিলবে ভূরি ভূরি। একসময় ঘরকুনো বলে বদনামের ভাগীদার ছিল বাঙালি। তার সে বদনাম বিংশ শতকের তিনের দশক থেকে ঘুচতে শুরু করে, বিশেষত ১৯৩১ সালে কেবল সাইকেলে চড়ে পুরোপুরি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশের যুবক রামনাথ বিশ্বাসের (১৮৯৪-১৯৫৫) বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়ার ঘটনার ভেতর দিয়ে। সাইকেলে বা পায়ে হেঁটে বিশ্বের সাতটির মধ্যে পাঁচটি মহাদেশের প্রায় ৫০ হাজার মাইল পথ তিনি অতিক্রম করেছিলেন। আর সেই ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লিখেছিলেন বেশ কিছু গ্রন্থ। সেগুলো বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল। রামনাথ বিশ্বাসের একটি ভ্রমণগ্রন্থের নাম ছিল তরুণ তুর্কি। কথাটা যে পরে জনপ্রিয় একটি বিশেষণগত বাচিক ভূষণে পরিণত হয়েছিল, তার মূলে রামনাথ বিশ্বাসের ওই গ্রন্থ। বাঙালির ভ্রমণ বা সফর বা পর্যটনের সুযোগ অবারিত হয় বিশেষভাবে বিংশ শতকের পাঁচ ও ছয়ের দশকের শুরু থেকে। মূলে আর কিছু নয়, বিমান, রেল, বাস ও নদীপথে দেশ ও বিশ্বের প্রায় প্রতি-কোণ-ছোঁয়া যোগাযোগব্যবস্থার বিস্তৃতি। ফলে আমাদের ভ্রমণ-সাহিত্য নানা দিকে বিস্তার করতে থাকে তার ডালপালা। তার ঋদ্ধি আজ এতটাই স্ফীত যে, আমরা সাহিত্যের এই শাখাটিকে নিয়ে রীতিমতো গর্ব করতে পারি। ঠিক এ রকমের এক পটপ্রেক্ষায় আমাদের হাতে এসেছে দেশের বিশিষ্ট চিত্রকর ও কার্টুনিস্ট রফিকুন নবীর ভ্রমণবিষয়ক গ্রন্থ রণবীর বিশ্বদর্শন ও রম্যকথন। নিজের লেখালেখি বিষয়ে সাফাই গাইতে গিয়ে লেখক বলেন, ‘তো দেশে-বিদেশে ঘোরাঘুরি কম হলো না। কিন্তু সেসব নিয়ে লেখার কোনো দিন ইচ্ছে হয়নি। এমনকি অনেকের যে ডায়েরি লেখার সুঅভ্যাস আছে আমার তাতেও আলসেমি। গুছিয়ে-গাছিয়ে বসা হয় না। সাধ্যও নেই। আসলে ‘লেখার-হাত’ বলে যে কথাটি রয়েছে তা আমার ধাতে নেই। এমনকি কলেজপড়ুয়া সময়টিতে যে প্রেমপত্র লেখালেখি দিয়ে সবার হাত পাকে, সেদিকটাও তখন তেমন হয়ে ওঠেনি। এ-ব্যাপারে অতএব নিজেকে ‘বেচারা’ ভাবা ছাড়া উপায় নেই।’ তাঁর এ মতো উচ্চারণের মুখে তাঁকে রীতিমতো বিনয়ের অবতারই বলতে হয়। ‘বেচারা’ বলে নিজেকে যেভাবে তিনি করুণা করেন, তাতে করে ঢাকা পড়ে যায় না তাঁর এই গ্রন্থভুক্ত ১৯টি নিবন্ধের পাঠস্পৃহা জাগিয়ে তোলার প্রবল গুণগত শক্তি। নানা উপলক্ষে সময়ের ব্যবধানে শিল্পী রফিকুন নবী ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের মোট ২৫টি দেশ সফর করেছেন। কখনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বসবাসও করেছেন কোনো কোনো দেশে। তবে বেশির ভাগই সফর। আমি তাঁর এই সফরকে শিল্প-দর্শনগত সফরই বলতে চাই। আর এসব সাফরিক অভিজ্ঞতাই রম্য কথনভঙ্গির ভিয়েনে তিনি যখন ভিন্ন ভিন্ন প্রবন্ধ তুলে ধরেন, তখন সেগুলো নিটোল সুখপাঠ্য, সুস্নিগ্ধ ও সুপাচ্য রচনার সুউজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। লেখক যখন যেসব দেশে যাচ্ছেন বা থাকছেন, তাঁর লেখায় উঠে আসছে সেসব দেশের বর্তমান, প্রাচীন ও পরিবর্তিত রূপটির বিবরণ; সেই সঙ্গে ইতিহাসও। যেমন—ইতালি বা রোম নগরী সম্পর্কে যখন তিনি বলেন, ‘ইতালীয় শহরগুলির রকমফের চোখে পড়ার মতো। দক্ষিণে একরকম, উত্তরে অন্যরকম। সেদিকে যত যাওয়া যায় ততোই খাঁটি ইউরোপ এগিয়ে আসে সবকিছুতে ভর করে। প্রকৃতিতে যেমন ভিন্নতা, তেমনি মানুষের আচার-ব্যবহার, সংস্কৃতি, বলতে গেলে সবটাতেই বদলে-যাওয়া বিদ্যমান। তবে পুরো ইতালি জুড়েই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রাচীন রোমীয় সভ্যতার নিদর্শন। ‘আমাদের এই সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে অতশত দেখার সময় বা সুযোগ ছিল না। শিল্পকলার এত দিক রয়েছে যে, তা থেকে বাছাই করে দেখা ছাড়া উপায়ও ছিল না। শুরুটা হয়েছিল রোম দিয়ে, শেষটাও তাই। রোমই প্রাচীন রোমানদের শৌর্য-বীর্যের, জ্ঞান-গরিমার স্মৃতিবহনকারী প্রধান শহর। আমাদের পৌঁছানোটাও প্রথম সেখানেই। অতএব, তা দিয়েই শুরু দেখাদেখির।’ রফিকুন নবীর এ-জাতীয় বর্ণনার গুণে সেই মহিমান্বিত রোম নগরী, পাশাপাশি তাঁর সফর-অন্তর্গত অন্য নানা দেশ এতটাই জীবন্ত হয়ে ওঠে যে, মনে হয় লেখক নন, আমি নিজে সেই সব দেশ সফর করছি। চলে যাচ্ছি তাদের সুদূর অতীতে, আবার ফিরে আসছি বর্তমানে। শুধু কোনো নির্দিষ্ট দেশের ভূদৃশ্যাবলিই নয়, তাঁর সফর-অন্তর্গত দেশের পর দেশের মহান শিল্পী ও তাঁদের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকর্ম দেখার যে বিবরণ তুলে ধরেন তিনি, এ গ্রন্থ যেন তারও এক বিশাল ভান্ডার হয়ে উঠেছে। সে বিচারেও এ গ্রন্থ এক অমূল্য দলিলবিশেষ। সত্যিই তো এ গ্রন্থ রফিকুন নবীর বিশ্ব দর্শনেরই চালচিত্র। বিশ্বের ২৫টি দেশের শিল্পকলা, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং অতীত ও বর্তমানের স্থাপত্যিক নিদর্শন নিজের চোখে দেখার বিবরণ যখন তিনি একান্ত নিজস্ব গদ্যশৈলী-সহযোগে তুলে ধরেন, তখন তাকে ‘রণবীর বিশ্ব দর্শন’ অভিধায় অভিহিত করাই সংগত। ফলে আমাদের ভ্রমণসাহিত্যে শুধু নয়, রম্য বা রস-সাহিত্যের ভান্ডারেও এক অমূল্য সংযোজন ও মর্যাদার অধিকারী রনবীর বিশ্ব দর্শন ও রম্যকথন। রফিকুন নবী নিজেকে ‘বেচারা’ বলে তাচ্ছিল্য করার অধিকার হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি স্বমহিমায় মণ্ডিত পরিপূর্ণ লেখক। এ গ্রন্থের জন্য তাঁকে অভিনন্দন।